Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি : জনগণের অধিকার বনাম মুনাফালোভী মনোভাব

Icon

রাকিবুল রনি

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৫

গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি : জনগণের অধিকার বনাম মুনাফালোভী মনোভাব

১৯১৬ সালে তোসামারু জাহাজে চড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়েছিলেন জাপানে। যাত্রাপথের শহর-বন্দর এবং জাপান ভ্রমণের স্মৃতি ও তার অনুভূতি সযত্নে টুকে রেখেছিলেন ডায়রিতে। পরবর্তী সময়ে ‘জাপানযাত্রী’ নামে বই আকারে তা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের এই ডায়রিতে এসেছে কলকাতার প্রসঙ্গ। কলকাতা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাণিজ্য সভা যতই প্রবল হয়ে উঠতে লাগল ততই দেশের রূপ আচ্ছন্ন হতে চলল। দেশ ও কালের লড়াইয়ে দেশের শ্যামল শোভা পরাভূত হলো, কালের করাল মূর্তিই লোহার দাঁত নখ মেলে কালো নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল।’ ১০০ বছরের অধিক সময় পরও কলকাতা সম্পর্কে ডায়রিতে লেখা কবির এই কয়টি শব্দ আজও প্রাসঙ্গিক। কবির দেখা সেই কলকাতা ‘লোহার দাঁত নখ মেলে কালো নিঃশ্বাস’ ছেড়ে ডালপালা মেলে আজ বিস্তৃত বহুদূর। 

বুড়িগঙ্গা পারের দৃষ্টিনন্দন ঢাকারও আজ একই হাল। সঠিক পরিকল্পনায় যে শহরটি হয়ে উঠতে পারত ইতালির ভেনিসের মতো নৌপথবেষ্টিত এক শহর, অথচ তুমুল মুনাফালোভী পুঁজিপতিদের সর্বগ্রাসী তৎপরতায় ঢাকা আজ শপিং মল আর বিলবোর্ডের শহর-সূর্য ঢেকে দেওয়া সুউচ্চ দালানে ঠাসা ঘর্মাক্ত ইট-পাথরের অসহনীয় হিট আইল্যান্ড। এর মাঝেও এই শহরে যাদের বাড়ি-গাড়িতে এসি রয়েছে তারা আরো উত্তাপ ছড়িয়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছাড়ছে।

একটি শহরের অন্তত ২০ শতাংশ সবুজ ও উন্মুক্ত এলাকা থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্য মতে, ঢাকায় তা আছে মাত্র ৭ শতাংশ। 

এই বাস্তবতায় ঢাকায় যে কয়টি সবুজ অঞ্চল এখনো কোনো মতে টিকে আছে, সেগুলোও দখলে নেওয়া কিংবা অন্তত গাছপালা কেটে দামি রেস্তোরাঁ তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে! রেহাই পাচ্ছে না উনসত্তরের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ আনোয়ারা উদ্যানও। ফার্মগেটের শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একজন আনোয়ারা বেগমের নাম। যিনি নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাড়ির ভেতরে বসে চার মাসের কন্যাসন্তান নার্গিসকে মাতৃদুগ্ধ পান করাচ্ছিলেন ১৯৬৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। সেদিন গণ-অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন, বর্বর পাকিস্তান সরকারের পেটোয়া সেনাবাহিনীর একটি গুলি টিনের বেড়া ভেদ করে আনোয়ারা বেগমের পিঠ ভেদ করে দুগ্ধপানরত শিশু নার্গিসের শরীরে লাগে। আনোয়ারা বেগম শহীদ হন, কিন্তু আহত হলেও শিশু নার্গিস বেঁচে যায়। শহীদ আনোয়ারা বেগমের আত্মত্যাগের স্মৃতি অম্লান রাখতে ফার্মগেটের এই উদ্যানটির নামকরণ হয় শহীদ আনোয়ারার নামে। 

 দখল হয়ে যাওয়া শহীদ আনোয়ারা উদ্যামনের সাম্প্রতিক চিত্র। ছবি : সংগৃহীত

এই উদ্যান গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছ থেকে ২০১৮ সালে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেলের মালামাল রাখার কাজে অস্থায়ী ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমতি পায়। আজ অব্দি অস্থায়ী অনুমোদনের ভিত্তিতে মালামাল রাখা ও প্রকল্প অফিসের কাজে ডিএমটিসিএল উদ্যানটি ব্যবহার করে আসছে। এত কিছু পেয়েও প্রতিষ্ঠানটির নতুন চাওয়া, পার্কের অবশিষ্টাংশে তারা স্টেশন প্লাজা বানাবে! তাদের মুনাফা লাগবে। মুনাফা তাদের লাগতেই পারে, কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষের আত্মদানের স্মৃতিকে বিলীন করে দিয়ে! 

ঢাকার অন্যতম জনাকীর্ণ অঞ্চল ফার্মগেটে শহীদ আনোয়ারা পার্কের ঐতিহাসিক গুরুত্বের বাইরেও এর ব্যাবহারিক প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। শপিং মল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, হাসপাতাল আর শত শত বহুতল ভবন রয়েছে ঢাকার এই অংশে। তাদের সবার জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্যে অবকাশ যাপনের একমাত্র জায়গা এই উদ্যান। ঢাকার বাসিন্দা নন এমন হাজার হাজার মানুষও প্রতিদিন এই ফার্মগেটে আসেন। তাদের কিছু সময়ের অপেক্ষা, কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ার জায়গা ছিল শহীদ আনোয়ারা উদ্যান। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী আর ঘরহীন শিশুদের খেলার জায়গা, প্রবীণ নাগরিকদের বৈকালিক ভ্রমণের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় ছিল এই উদ্যান। তা ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর ও মন এখানে খুঁজে পেত শান্তির সুবাতাস। এই অল্প জায়গাটুকুও মুনাফার লোভে কেড়ে নিতে হবে জনগণের থেকে? 

২০২৪ সালের ১৮ মে ঢাকার পরিবেশ সচেতন মানুষ, ফার্মগেট এলাকায় বসবাসরত লোকজন, স্কুলে পড়া বাচ্চা থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষ, নগর পরিকল্পনাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক-সবাই ডিএমটিসিএলকে ৩০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলেন উদ্যানের দখল ছাড়তে। তারপর একই বছরের ১১ জুন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ের সামনে আনোয়ারা উদ্যান রক্ষা আন্দোলনের সমাবেশে সংহতি জানিয়ে তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, ‘খোদ প্রধানমন্ত্রীই চান না আনোয়ারা উদ্যানের জায়গায় শপিং মল হোক’ এবং তারা ডিএমটিসিএলকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন উদ্যানটি দখলমুক্ত করে সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দিতে। এর আগে ২০২৩ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা গত ২৩ ডিসেম্বর শহীদ আনোয়ারা উদ্যান পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তারা পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল রক্ষার দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি স্থল পান্থকুঞ্জে যান। সেখানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ২০২৫ সালের ২৬ মার্চের মধ্যে শহীদ আনোয়ারা উদ্যান জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন এবং জানান, ইতোমধ্যে সেখানে থাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সব স্থাপনাসহ সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে! সেখানে উপদেষ্টারা জানিয়ে এসেছিলেন দ্রুত পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল রক্ষার দাবিতে আন্দোলনরতদের সঙ্গে সভায় বসবেন। তারা সেই সভার আয়োজন করেননি, রাখেননি শহীদ আনোয়ারা উদ্যান জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও। উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির ছয় মাস পেরোল, সঙ্গে ডিএমটিসিএলের প্রতি তার নির্দেশনারও! উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে তৎকালীন মেয়রের সমর্থনের পর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উদ্যানটি নিজেদের কবজায় রাখতে নতুন অজুহাত হাজির করেছিলেন। বলেছিলেন, কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল না হওয়া পর্যন্ত নাকি উদ্যানের ‘উন্নয়নের’ কাজ করা যাবে না। উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির পর তারা কিছুটা নরম হলেও নতুন নতুন অজুহাতে কালক্ষেপণ করে যাচ্ছেন। প্রতিশ্রুত সময়ের পর তাদের বক্তব্য ছিল জুনের মধ্যে উদ্যান থেকে মেট্রোরেলের মালামাল সরিয়ে নেবেন তারা। অথচ সেই জুনও ফুরলো, কিন্তু উদ্যান স্বরূপে ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। 

জুলাইয়ে এসে নতুন অজুহাত, স্থাপনা সরাতে টেন্ডার আহ্বান করবেন তারা, সরানোর কাজ শুরু হবে আগস্টের শেষের দিকে আর উত্তর সিটি করপোরেশনকে উদ্যান বুঝিয়ে দেবেন সেপ্টেম্বরে! সেই ২০১৮ সাল থেকে সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে জনগণের এই উদ্যান কুক্ষিগত করে রেখেছে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। তবু তাদের আরো সময় চাই! স্থাপনা সরানোর কাজ শুরু করবেন উপদেষ্টার নির্দেশনার আট মাস পর? আদৌ করবেন কি, নাকি নতুন অজুহাত নিয়ে হাজির হবেন? উপদেষ্টার নির্দেশ অমান্য করার দুঃসাহসের উৎস কী? নাকি খোদ অন্তর্বর্তী সরকারই জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে আগ্রহী মুনাফার কাছে? সময়ে সময়ে উপদেষ্টা, মেয়র, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই চাইলেও জনগণের উদ্যান জনগণের কাছে ফিরবার দৃশ্যখানা কোন অদৃশ্য ইশারায় আর মুনাফার পাঁয়তারায় ঝুলে আছে, তা ভেবে কূল পাওয়া বড্ড মুশকিল!

ছাত্র-শ্রমিক-জনতার রক্তে গড়া মসনদে যারা বসে আছেন এই মুহূর্তে, তারা অন্তত অর্থ ও ক্ষমতার দৌরাত্ম্যের কাছে নাগরিক অধিকার খুন হতে দেবেন না, এমন আশা করা কি বাড়াবাড়ি? 

ফার্মগেটের ফুসফুস আবার সতেজ হবে, দ্রুত সাজবে নতুন রূপে-এমন প্রত্যাশা কি অমূলক? বাড়াবাড়ি নাকি অমূলক-সেই প্রশ্ন তোলাই প্রকৃতপক্ষে অবান্তর। বরং জনগণের উদ্যান জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। আশা করি, সেই দায়িত্ব পালনে সরকার কার্যকর উদ্যোগ নেবে। আশা করি, উদ্যানটি মেট্রোরেলের কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে যে দুই শতাধিক গাছকে হত্যা করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক গাছ রোপণ করে যথাযথ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শেষে শহীদ আনোয়ারা উদ্যানকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে দ্রুত। আর অবশ্যই গাছ নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়া হবে নানা প্রজাতির দেশীয় গাছকে, যারা কেবল মানুষকে স্বস্তি আর অক্সিজেন দিয়ে ক্ষান্ত হবে না; বরং পশু-পাখির খাবারের উৎস আর নিরাপদ আবাসও হয়ে উঠবে। চাই উদ্যানের নকশায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতির ছাপ থাকুক, থাকুক শহীদ আনোয়ারা বেগমের আত্মত্যাগের কাব্য! ধনী-দরিদ্র, তরুণ-বৃদ্ধ, দিনমজুর-উচ্চবিত্ত চাকুরে-সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠুক শহীদ আনোয়ারা উদ্যান। উদ্যান হোক প্রতিবন্ধীবান্ধব, উদ্যান হোক মুনাফার লালসামুক্ত। নগর, রাষ্ট্র, মেট্রোর কর্তাদের প্রতি একটাই আহ্বান, ঢাকার অবশিষ্ট পার্ক-উদ্যান, খোলা ময়দানকে বাঁচান; মুমূর্ষু গাছেদের বাঁচতে দিন। নইলে আমরা বাঁচব না বেশি দিন।


লেখক : গবেষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫