
জুলাইয়ের আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। রাজপথে গণ-আন্দোলন ও জনগণের প্রবল চাপের মুখে একপর্যায়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে। সেই শূন্যতার মুহূর্তে গঠিত হয় একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকার’, যা বিদ্যমান সরকারের স্থলে দায়িত্ব নেয়। তবে এখানেই উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এই সরকার কি আইন অনুযায়ী গঠিত হয়েছিল? এই সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা কতটা?
২০২৪ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ১২তম জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এর দুই দিন পর, ৮ আগস্ট আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। তিনি একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক সরকার গঠন করেন, যা দেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথচ এই পুরো প্রক্রিয়াটি কোনো বিদ্যমান আইন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে হয়নি।
১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল, যার মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন পরিচালিত হতো। কিন্তু ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিধান বাতিল করা হয়। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টও তার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। ফলে ২০২৪ সালে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে কোনো পূর্ববর্তী আইন বা সাংবিধানিক ধারা কার্যকর ছিল না। বরং এই সরকার গঠনের ভিত্তি ছিল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ, যেখানে রাষ্ট্রপতি জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে পারেন। সেই রেফারেন্সের ভিত্তিতেই আদালতের উপদেষ্টারা অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শ দেন। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার প্রধান এবং তার নেতৃত্বেই মন্ত্রিসভা পরিচালিত হয়। কাজেই সাধারণ নিয়মে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমেই নির্ধারিত হওয়ার কথা।
অথচ ২০২৪ সালের বাস্তবতায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রধানমন্ত্রীসহ বেশির ভাগ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য দেশ ছেড়ে চলে যান। দেশে কার্যকর কোনো সরকার তখন আর অবশিষ্ট ছিল না। এই পরিস্থিতিতে একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়, যার পেছনে তেমন কোনো সুস্পষ্ট আইনি প্রক্রিয়া ছিল না। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে নিরপেক্ষ বা অরাজনৈতিক সরকারের কোনো ধারাই নেই। তবে এই শূন্যতা পূরণের ক্ষেত্রে বড় হয়ে দাঁড়ায় জনগণের আকাক্সক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। কারণ যখন জনগণ ব্যাপকভাবে একটি সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে এবং স্বাভাবিক সাংবিধানিক ধারায় ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন সেই প্রেক্ষাপটে আইন কখনো কখনো নমনীয়তা দেখাতে বাধ্য হয়।
এই যুক্তিতেই আপিল বিভাগের উপদেষ্টারা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে মত দেন। তারা মূলত জনমতের চাপে উদ্ভূত সংকটকে শান্তিপূর্ণভাবে নিরসনের একটি পথ দেখান। অতীতেও আমরা এমন দৃষ্টান্ত দেখেছি। ১৯৯৬ সালে গণ-আন্দোলনের পর সংসদে আইন পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল। আবার ২০০৭ সালে সামরিক-পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত একটি অন্তর্বর্তী সরকার কার্যত সংবিধানের বাইরে গিয়েই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। সেই সময়ও বিষয়টি বিতর্কিত ছিল, কিন্তু বাস্তবতা অনেক কিছু মেনে নিতে বাধ্য করেছিল।
২০২৪ সালের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ছিল অনেকটা একই রকম। আন্দোলন, সংকট ও রাজনৈতিক আপসের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রশ্ন হলো, এটিকে কি ‘আইনিপ্রক্রিয়া’ বলা যায়? আমরা কি কেবল বইয়ে লেখা আইনের ধারা অনুসরণ করেই সব রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা নির্ধারণ করব? নাকি প্রয়োজন অনুযায়ী আইনকেও কখনো বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ধারণ করে দেবে, ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তী সরকার কতটা আইনসম্মত ছিল। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনীতি সব সময় আইনকে অনুসরণ করে চলে না। বিশেষ করে যখন গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়, তখন আইন কিছুটা পিছিয়ে পড়ে এবং জনগণের দাবিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয় পরিস্থিতিকে আইনের পথে ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার প্রশ্নবিদ্ধ না হয় কিংবা আইনি শূন্যতায় পড়ে না যায়। এই কারণেই সরকার গঠন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি। সেটা নির্বাচিত হোক কিংবা অন্তর্বর্তী, সব ধরনের সরকারই হতে হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং আইনের ভিত্তিতে গঠিত। ২০২৪ সালের আন্দোলন এবং সরকার পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে এক বাস্তব শিক্ষা রেখে গেল। ভবিষ্যতে এমন সংকট যেন আর না ফিরে আসে, এটাই দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের প্রত্যাশা।