Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটল বা বাড়ল

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৪:২০

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটল বা বাড়ল

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সব প্রস্তুতি, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক প্রস্তুতিগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।

এর তিন দিন পরে গত ১২ জুলাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে। তবে নির্বাচন কবে হবে সেটা তারা জানেন না। কেননা নির্বাচনের তারিখ জানাবে নির্বাচন কমিশন।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রোজার আগে অথবা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। তার ভাষায়, তারা প্রথম থেকেই ডিসেম্বরকে টার্গেট করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে কমিশনের প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো গাইডেন্স নেই। পরামর্শ বা আদেশ নির্দেশও নেই। বরং কমিশন স্বাধীনভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিইসি বলেন, তাদের লক্ষ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। তার মানে সিইসির কথায় এটা পরিষ্কার নয় যে, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে নির্বাচন হবে। তিনি এপ্রিলের কথাও বলছেন।

প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা শুরু থেকে বলছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কম সংস্কার চাইলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে, আর বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। কিন্তু গত কোরবানির ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। যদিও তখন বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে, এমন একটি শক্ত অবস্থানে ছিল। এ রকম বাস্তবতায় গত ১৩ জুন লন্ডন বৈঠকের পরে যৌথ বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যদি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায় এবং বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা যায়, তাহলে ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগেই নির্বাচন হতে পারে।

এই যৌথ বিবৃতির পরে অনেকেই, বিশেষ করে বিএনপি বিশ্বাস করছে যে, রোজার আগেই নির্বাচন হবে। এই বৈঠকের পরে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি থেকে সরে আসে। তা ছাড়া ফেব্রুয়ারির ডেডলাইনটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সেনাপ্রধান জেনারেল 

ওয়াকার-উজ-জামান গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তার ওই ১৮ মাস শেষ হবে ফেব্রুয়ারিতে। এরপর গত মধ্য এপ্রিলে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই আগামী রমজানের আগেই তারা নির্বাচন চান। সুতরাং সেনাবাহিনী এবং দেশের অন্যতম প্রধান দল যখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলে এবং যৌথ বিবৃতিতেও যখন ফেব্রুয়ারির কথা উল্লেখ করা হয়, তখন এটা মনে করাই সংগত যে, রোজার আগেই নির্বাচন হবে। যে বিশ্বাস আরো দৃঢ় করেছে গত ৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা এবং ১২ জুলাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথা। যদিও সিইসির কথায় এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে নাকি এপ্রিলে।

এপ্রিল মাস যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয়, সে কথা অনেকবার বলা হয়েছে। বাংলাদেশের যে জলবায়ু ও আবহাওয়ার ধরন, সে কারণে এপ্রিল মাস যেমন ভোটের উপযোগী নয়, তেমনি এই মাসে সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হয়। এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা হয়তো জুন মাসের কথা বলেছিলেন। কিন্তু জুন মাসও ভোটের জন্য খুব উপযোগী নয়। বরং বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো সময় এবং এই সময়ের মধ্যেই দেশের বেশির ভাগ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। যে কারণে অনেকের মনে এই সন্দেহ আছে যে, যদি ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হয়, তাহলে এটি এপ্রিল এমনকি জুনেও হবে কি না? অর্থাৎ নির্বাচনটি আরো লম্বা সময়ের জন্য ঝুলে যাবে কি না বা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে কি না?

এই প্রশ্ন উঠছে নানা কারণেই। সরকার ঘনিষ্ঠ দলগুলো এখনো ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে-এমন কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি। জামায়াত রোজার আগে নির্বাচনের দাবি জানালেও পরে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসে সংস্কার ও বিচারের পরে জাতীয় নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তার মানে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বড় দলগুলোর মধ্যে সোচ্চার কেবল বিএনপি। কারণ তারা বিশ্বাস করে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় আসবে। অন্য দলগুলো হয়তো এ কারণেই দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। বরং তাদের অনেকেই সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়েছে, যাতে ভোট প্রাপ্তির অনুপাতে সব দল সংসদে আসন পায়। অর্থাৎ কোনো দল যদি ১০ শতাংশ ভোটও পায়, তার পরও তারা ৩০টি আসন পাবে। দেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় এর সুযোগ নেই। যে কারণে এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে মূলত দুটি বিষয় সামনে নিয়ে এগোচ্ছে-১. বিচার ও কাক্সিক্ষত সংস্কারের আগে নির্বাচন নয় এবং ২. পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন।

সুতরাং সরকার যদি এই দুটি বিষয় বিবেচনায় নেয়, তাহলে ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগে নির্বাচন কঠিন। কেননা, বিচারে কতটুকু অগ্রগতি হলে সেটিকে ‘পর্যাপ্ত’ বলা হবে এবং ‘সংস্কার’ বলতে কী কী সংস্কার, সেটি সরকারের তরফে যেমন পরিষ্কার করা হয়নি, তেমনি সরকার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোও স্পষ্ট করেনি।

ফেব্রুয়ারি আসতে এখনো বাকি সাত মাস। এই সময়ের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা বলা কঠিন। যারা এখনই নির্বাচন চায় না সেসব দল, এমনকি সরকার নিজেও যদি দ্রুত ক্ষমতা ছাড়তে না চায় তাহলে তারাও এমন সব পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যাতে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে অথবা তারা এমন কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসতে পারে, যাতে নির্বাচনের আলোচনাটি আর মুখ্য না থাকে।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে হত্যার পরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র কি না-এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ১৪ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত চলছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। তবে যারা রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট এবং জাতীয় নির্বাচন বাধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত করতে চায়, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিহত করার প্রত্যয়ও জানান বিএনপির মহাসচিব।

মনে রাখতে হবে, জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো নিবন্ধন না পেলেও তারা এই সময়ের বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর। বিশেষ করে এই দলটির প্রতি সরকারের ‘সমর্থন’ থাকায় তারা যা চাইবে, তার বাইরে গিয়ে সরকারের পক্ষে খুব বেশি কিছু করা কঠিন হবে বলে অনেকেই মনে করেন।

এই সময়ের মধ্যে দেশের অন্যান্য পরিস্থিতি, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট, আরাকান আর্মি এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি কেমন হবে, এখানে কী কী ঘটবে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। যদি সীমান্ত পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

অতএব, লন্ডন বৈঠকের পরে দেওয়া যৌথ বিবৃতি, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার তথ্য এবং সবশেষ সিইসির সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে না হলেও অন্তত এপ্রিলের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সম্ভাবনাটি সত্য হবে নাকি ‘সম্ভব নয়’-এ পরিণত হবে, তা এখনই বলা কঠিন। কেননা আগামী সাত মাস তো বটেই, আগামী ৫ আগস্ট এবং জুলাই সনদকে কেন্দ্র করেই দেশে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তাও বলা যায় না।

এটা ঠিক যে, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রে সংবিধান প্রদত্ত জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠাই জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম অঙ্গীকার। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি না করা বা এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়তা ও সমর্থন না দেওয়া, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত কিংবা অনিশ্চিত করবে। কেননা নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে গেলে দেশের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে যে বিশৃঙ্খলা, মব, নৈরাজ্য, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা এবং এসব কারণে অর্থনীতির ওপর যেসব ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলার একমাত্র উপায় হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। তারপর সেই সরকার দেশ পরিচালনায় কতটা সফল হবে বা হবে না, সেটি অন্য তর্ক। কিন্তু কোনো যুক্তিতেই একটি অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না। কেননা জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া একটি সরকারের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী বা ফ্যাসিবাদী শাসনের চেয়ে উত্তম কিছু নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫