
যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, নাম, পরিচয় কিংবা কোনো ধরনের ঠিকানা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এ বিষয়ে আমাদের দেশে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’-এর ১৪(১) ধারায় পরিষ্কারভাবে বলা আছে, এমন ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী বা শিশুর কোনো পরিচয় এমনভাবে প্রকাশ করা যাবে না যাতে করে তাদের চেনা যায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি তা-ই বলছে? আজকাল বেশ কিছু গণমাধ্যম এসব বিধান মানছে না। কোথাও মুখে ঝাপসা (ব্লার) দেওয়া ছবি, আবার কোথাও নাম-পরিচয়-ঠিকানাসহ একেবারে খোলামেলা ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কে বেশি আলোচিত বা ‘দৃষ্টিনন্দন’ ছবি ছাপাবে! অথচ বিষয়টি যে শুধু নীতিগত ভুল নয়, আইনেরও লঙ্ঘন, অনেকেই যেন তা ভুলে গেছেন।
আইনের ১৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, এই ধারা লঙ্ঘন করলে দায়ী ব্যক্তি অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ কাজটি নিছক ভুল নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইন বাস্তবায়নের দাবিতে মানবাধিকার সংগঠন ‘জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশন’ গত বছর হাইকোর্টে রিট করে। পরে সেই রিটের শুনানিতে আদালত ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, নাম, পরিচয়, ঠিকানা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থল-এ সবকিছুই গণমাধ্যমে প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। গণমাধ্যমগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে তারা যেন ভিকটিমদের পরিচয় গোপন রাখে। তবে আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও কিছু গণমাধ্যম তা মানছে না। বরং আদালতের আদেশকে তোয়াক্কা না করে তারা নিয়মিত এসব আইন লঙ্ঘন করছে। এ আচরণ শুধু দায়িত্বহীনতাই নয়, আদালতের আদেশের প্রতি অবমাননার শামিল। সম্প্রতি নোয়াখালীর এক ধর্ষণ ও হত্যা মামলার ভিকটিমের ছবি প্রকাশ এর বড় উদাহরণ। এই ভিকটিম একজন শিশু, যার পরিচয় প্রকাশ করা আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ তার নাম, ছবি, বয়সসহ বিস্তারিত তথ্য অনেক গণমাধ্যমেই উঠে এসেছে। শুধু এই ঘটনাই নয়, অনলাইনে খোঁজ করলেই এমন শত শত ছবি ও রিপোর্ট মিলবে। মনে রাখা দরকার, ভিকটিম যদি ধর্ষণের শিকার না হয়ে বরং অভিযুক্তও হতো, তাহলেও তার ছবি বা পরিচয় প্রকাশ করা যেত না, যেহেতু সে শিশু।
২০১৯ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে জানিয়েছিলেন, বিচারাধীন কোনো মামলার শিশুকে অপরাধী, আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত-এ ধরনের শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে না। এমনকি বিচার চলাকালে, বিচার শেষে কিংবা পরে তার ছবি বা এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যাতে করে তাকে চেনা যায় বা সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রায়ে আরো বলা হয়েছিল, কোনো শিশু যাতে ভবিষ্যতে কলঙ্ক নিয়ে বড় না হয়, সেটা মাথায় রেখেই এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এসব স্পষ্ট আইন, আদালতের নির্দেশ ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থাকার পরও কেন এসব উপেক্ষা করে চলছে এমন সংবাদ প্রকাশ? এটি কি কেবল সাংবাদিকদের দায়িত্বহীনতা? না কি তারা সচেতনভাবে আইনের বাইরে গিয়ে এমন করছে? নাকি এসবের পেছনে আছে অজ্ঞানতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি? আর যেসব সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল এসব আইন প্রয়োগ করা, তারা কি নিজেরা দায় এড়াতে পারেন?