Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

অচিন পাখি কে? লালন ফকিরের সন্ধানে আমরা কজন

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১৪:০৬

অচিন পাখি কে? লালন ফকিরের সন্ধানে আমরা কজন

আমার এক প্রকাশক বন্ধু জানাল যে ‘লালন ফকিরে’র ওপর ইংরেজিতে একটি বই করতে চায় সাধারণ বিদেশি ও দেশি পাঠকের জন্য। আমাকে হাত লাগাতে বলে। আমি খুশি হই কারণ লালন আজ নানা আলাপে আছে। কেন এতদিন আছে জানার ইচ্ছা আমারও।

আমি তার গানের ভক্ত। ইউটিউবে আমি সবচেয়ে বেশি শুনি লালনের গান। কিন্তু গানের শ্রোতা আর গবেষক তো এক নয়, তাই রাজি হলাম, রীতিমতো একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এক  নয়া প্রজন্মের সঙ্গে গড়ব গবেষকের দল। যেমন ছিল লালনের কালে। তারা খুঁজত অন্তরের ‘মনের মানুষ’, আর আমরা খুঁজব বাউল আর ফকির লালন কে ও কারা।

দুই

দলের নাম হলো  ‘লালন স্টাডি গ্রুপ’। সদস্য আটজন, ছয় কন্যা আর একজন বালক,  প্লাস এক বৃদ্ধ, আমি। সবাই লেকচারার বা গবেষক লেভেলের তরুণ-তরুণী, লালনের গান শোনে বা জানে; কিন্তু এই নিয়ে গবেষণা তাদের নতুন পরিসর।  বিভিন্ন বিষয় ভাগ করে নিয়ে পাঠ  শুরু হলো। আমি একাধিক বিষয় পড়াই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে, কিন্তু ইতিহাস প্রধান। তাই লালন কালের পটভূমি নিয়ে ব্যস্ত হলাম 

প্রথম।  সেই কালের বাংলার আর্থ-সামাজিক কাঠামো কেমন ছিল তা জানা দরকার প্রথম। কেবল কাগুজে বই নয়, ইন্টারনেটে বহু লেখা রয়েছে, শুরু হলো সন্ধান। আমার দলের আখড়ায় একটাই আলাপÑকে এই লালন শাহ? মজাটা হলো সবাই ইংরেজির নানা বিষয়ের স্টুডেন্ট, কিন্তু প্রবেশ করল বাংলা ফোকলোরের  দুনিয়ায়। আনন্দে।

তিন

আমরা প্রথম এক মাস শুধু পাঠ করলাম, দেশি-বিদেশি বই। তারুণ্য কম্পিউটার যুগের মানুষ, তথ্য অনুসন্ধান করে অনেক দ্রুত।  সেগুলো নামিয়ে পাঠ করে সামারি বানিয়ে আমাকে পাঠাল। আমার কৌতূহল ছিল এই বাউল চর্চার ঐতিহাসিক সূত্র নিয়ে। আসলেই আমার বহু ধারণা পাল্টাতে লাগল যত আগাতে লাগলাম। আমার একই কিসিমের বিভিন্ন ‘বাউল’ গোষ্ঠী নিয়ে ধারণা কম ছিল, জানলাম তাদের কথা। এক তরুণ মেধাবী গবেষক। লেখকÑআর্য সারথি অনেক কিছু জানাল। আর আমি ঢাউস ঢাউস একাধিক পিএইচডি আর ডিগ্রির জন্য লেখা থিসিস পড়লাম। দেশ-বিদেশের লেখার মধ্যে মিল আছে, অমিলও। তবে সবাই লালন শাহকে শ্রদ্ধা করে, কেউ কেউ ভীষণ। আমার পিচ্চি বাহিনীকে বললাম ‘সাবধান, ভক্তি গবেষণার শত্রু’। ‘জানি’, ওরা জানাল। এ যুগের গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি উত্তর খোঁজে নিরাসক্ত চোখ নিয়ে, অবজেকটিভ ক্রিটিক্যাল চোখ। মেধা চাই।   

চার

আমাদের দলে তিনজন হিজাবি, তিনজন নয়, কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অবস্থান গবেষণা প্রভাবিত করেনি। ওরা হলো প্রথমে গবেষক। দলের ম্যানেজার রেজওয়ানা, সবার লেখা ডিজিটাল তদারকি করেছে এবং তথ্য সূত্র ঠিক আছে কি না দেখেছে। সেদিক থেকে লালন নিয়ে এত ডিজিটাল কাজ হয়েছে কি না এই দেশে কে জানে। এরা আজকের দিনের সন্তান, যেকোনো স্থানে, অবস্থায় বই লেখা, পড়তে পারে। বাসে  করে যেতে যেতে ফোনে পড়ে, তারপর ফোন করে জিজ্ঞাসা করে এটা কি, ওটা কি।  

ওদের জন্য অনেক নতুন তথ্য, অনেক নতুন জানার বিষয় ছিল এই গবেষণা প্রকল্প। আমি বলেছিলাম, পণ্ডিতি লেখা যে কেউ লিখতে পারে, কিন্তু এমন লেখা দাও যেটা সবাই পড়তে পারবে। বিশেষ করে বিদেশিরা যারা লালনের কথা হয়তো প্রথম শুনছে। অতএব ওরা যেমন পড়ছে, জেনেছে, তেমনি জানাতে শিখেছে। এটা তো পরীক্ষা নয়-সবাই টপ স্টুডেন্ট, কিন্তু লেখা একজন মাস্টার নয়, ১০ জন পাঠক পড়বে। আমি দেখলাম ইতিহাসের লালনকে সন্ধান করতে গিয়ে আমার বর্তমান তারুণ্যের মেধার চিত্রের সন্ধান পাচ্ছি। দুটিই ছিল আমার জন্য উপভোগ্য, শিক্ষণীয়।

পাঁচ

একটানা তিন মাস কাজ করেছি প্রতিদিন। আমরা কয়েক শত লেখা পড়েছি, একাধিক বই পড়েছি, দেশি-বিদেশি। অনেক লেখা ছিল বেশ তাত্ত্বিক, কিন্তু সবই একটু শ্রদ্ধা ভরা। মনে হয়েছে এক আত্মিকতা বোধ আছে লেখকদের লালন বা বাউলদের সঙ্গে। কিন্তু আমাদের কাজ ছিল পুরাই অবজেকটিভÑশ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধার বিষয় নয়, জানার। জানানোর। এতে আবেগের কোনো সুযোগ নেই বা কম। তবে এটি ছিল সবার জন্য দারুণ এক সেমিস্টার। মুক্তভাবে পরীক্ষার চাপ না নিয়ে কেবল জানার পেছনে ছোটা। দারুণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু আটবার লিখে, এডিট করে আবার লিখে প্রকাশককে পাঠালাম। তখন বেশ মুক্ত বোধ করলাম আর প্রকাশক বন্ধু বিদেশ থেকে জানাল ‘ভালো’।

ছয়

কিন্তু আমাদের দলের যাত্রা চলতেই থাকে।  একদিন সবাইকে নিয়ে এই প্রজেক্ট থেকে কী জানলাম তা নিয়ে আড্ডা হলো। কয়েকটি বিষয় নতুন তাদের আছে, জেনেছে তারা। যেমন ধরা যাক :

-এই বাউল ধারার অনেক ধারা আছে, সব মিলিয়ে একটি নদীর মতো। লালন ছাড়াও আরো অনেকে আছে, ছিল, তাদের কথা কম শোনা যায়, আরো জানা ও জানানো উচিত।

-যদিও বাউলরা লালনসহ সমাজের নিয়মের বাইরে বসবাস করত, তাদের সৃষ্টি সামাজিক বাস্তবতা থেকেই এসেছে। এর সঙ্গে জড়িত সামাজিক নির্যাতন, ধর্মীয় শাসন বিশেষ করে তৎকালীন হিন্দু জাত প্রথা যার ভিকটিম লালন নিজেই, দারিদ্র্য ইত্যাদি। ওই বাস্তবতা বাদ দিয়ে  শুধু ‘মানব দরদী’ হিসেবে যে চিত্র উপস্থিত করা হয়, মাঝেমধ্যে সেটা অসম্পূর্ণ চিত্র। ঐতিহাসিক পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমাজ।

-নারীর অবস্থান দুর্বল ছিল সমাজে, এমনকি বাউলদের মধ্যেও। অর্থাৎ সবার জন্য সমান বললেও এই বাস্তবতা সেই সময়ে সম্ভব ছিল না, আজও নেই।

-বাউলদের অনেক ধারণা সবার কাছে গ্রহণীয়, কিন্তু কিছু ধারণা তাদের একান্ত নিজস্ব। তার সঙ্গে অনেকেরই খাপ খাবে না। তাই গান জনপ্রিয় হলেও বাউল ধারা সীমাবদ্ধ প্রকাশ হিসেবে থাকবে। তবে গান তাকে সবার কাছে নিয়ে গেছে।

-বহু মানুষ যেকোনো আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকে, একাধিক শ্রেণি থাকে, তারা জোট বাঁধে। লালনকে নিয়ে প্রথমে যারা লিখেছেন, কাজ করেছেন তারা কেউ কেউ মধ্যবিত্ত। যেমন-কাঙাল হরিনাথের মতো সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট বা উচ্চবিত্ত যেমন ঠাকুর পরিবার। একদিক থেকে যখন সবাই হাত মেলায় তখনই কিছু ঘটে। সবাইকে সবার দরকার।

-বাউল ভাবনা ইনফরমাল বা তরল কাঠামোর, তাই তাকে যেকোনো সময় নেওয়া যায় যে কোনো বিষয় নিয়ে। যার যেটা পছন্দ তা গ্রহণ করা যায়। এটা তার দুর্বলতা। শক্তি। তাই লালন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আইডেন্টিটি, অন্যদিকে লালনকে সবাই যেকোনো সময় ধারণ করতে পারবে। লালন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। সুফিবাদী, তান্ত্রিক বা বৈষ্ণববাদী, বিপ্লবী আর শান্তিবাদী সবার কাছে। এটাই তার সাফল্য, বিজয়। আমাদের দলের পক্ষ থেকে সবাইকে শুভেচ্ছা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫