
১৯৮৯ সালের কথা, আমাদের এলাকায় তখন ডাকাতি বেড়ে গিয়েছিল। এই ডাকাতদের পরিচালনা করত পতিত স্বৈরাচার এরশাদ শাহীর গুণ্ডাপাণ্ডারা। তবে এলাকার মানুষ কিন্তু তখন বসে থাকেনি। তারা উঠান বৈঠক করে রাতে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এমন অজস্র ঘটনা দেখেছি, সাধারণ মানুষ বড় বড় সংকট পার করেছে নিজেদের সংঘবদ্ধ আচরণ দিয়ে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, মনে হচ্ছে মানুষ তার সামাজিক দায়কে যেন আর বহন করতে চাচ্ছে না। এর আগের সরকারগুলোর বিচারহীনতার সংস্কৃতি হয়তো মানুষকে শঙ্কিত করেছে। সংঘবদ্ধহীন মানুষ এখন সামাজিক মাধ্যমে কোনো অঘটনকে ধিক্কার জানিয়ে দায় সেরেই যেন খুশি থাকে।
সমাজে বহুকাল জনগণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা না থাকায় ভয়ের যে সংস্কৃতি জমাট বেঁধেছে, সেটা থেকে মানুষের মুক্তি ঘটছে না। আমরা মনে করতে পারি পুরোনো ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যাকে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিবির সন্দেহে ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্বজিৎ দাসকে। শত শত মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য আর সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। যার নেপথ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একইভাবে আরেকটি অঘটন ঘটে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর। খাদিজা আক্তার নামের সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে বদরুল আলম নামের এক শাবি ছাত্র। বদরুল শাবি ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছিলেন। ৫ অক্টোবর বদরুল ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, প্রেমের প্রস্তাবে পাত্তা না দেওয়ায় এ কাজ করেছে। এসব ঘটনায় একটা কথা স্পষ্ট যে মানুষের সামাজিক অবস্থানের জায়গাটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। খাদিজা ও বিশ্বজিৎকে দুর্বৃত্তরা কোপাচ্ছে এটা যত লোক প্রত্যক্ষ করেছে বা ভিডিও করেছে, তারা একবার ফিরে দাঁড়ালে সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন রোধ করতে আর কাউকে লাগে না। কিন্তু মানুষ এখন সামাজিক দায় বহন করতে ভয় পায়। এ সুযোগে সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা, আতঙ্ক।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে হত্যা, নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ঘটনায় নৃশংসতার মাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে খুনের ধরনে ভয়াবহতা ও হিংস্রতা মাত্রা ছাড়াচ্ছে। ৯ জুলাই মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ) হাসপাতালের সামনে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। মানুষের অন্তর্গত নৃশংসতা কোথায় নেমে এসেছে সেটা ভেবে শেষ করা যাবে না। এ সময় কেউ-ই তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। সবাই ছিল নীরব দর্শক। ঘটনার দুই দিন পর এর ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
১১ জুলাই খুলনার দৌলতপুরে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে তার বাড়ির সামনে গুলি করে এবং দুই পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। একই দিন চাঁদপুরের একটি মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মসজিদের ভেতরেই কুপিয়ে জখম করা হয় ইমাম মাওলানা নূর রহমান মাদানীকে। জুমার নামাজের খুতবার সময় ইমামের দেওয়া বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায় ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন। গত ৩ জুলাই সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে দুই নারীসহ তিনজনকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শুধু এই ঘটনাগুলো নয়, কয়েক মাস ধরে দেশে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা বেড়ে গেছে।
একের পর এক নৃশংস হত্যা ও হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। সমাজ চিন্তক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, বিচারহীনতার কারণেই কথায় কথায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিকভাবে যে অচলায়তন তৈরি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে অপরাধী অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ না হওয়ায় অপরাধ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল করলে দেখা যায় একটা মানুষকে হেনস্তা বা হত্যা করার মতো অপকাণ্ড সংঘটনের সময় যত মানুষ সেটা ভাইরাল করতে মোবাইল দিয়ে ভিডিও করে, তার একটি অংশ যদি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বা একটু দায়িত্বশীল হয় তাহলে এই ঘটনা ঘটে না। কিন্তু সামাজিকভাবে মূল্যবোধের বিষয়টি বা সামাজিক দায়বদ্ধতা যেন মিইয়ে এসেছে। যে কারণে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বিরোধ, এলাকার আধিপত্য বিস্তার, মাদকের ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, দখল, চাঁদাবাজি, ব্যাবসায়িক বিরোধ, পারিবারিক কলহ এবং সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ নানা কারণে দেশে নৃশংসতা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে না পারায় এসব অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ১০ মাসে দেশের আট বিভাগে ১৭৪ জনকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) গত ছয় মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-গত ছয় মাসে কমপক্ষে ৫২৯টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনায় অন্তত ৭৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত চার হাজার ১২৪ জন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. এনামুল হক এ ব্যাপারে বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি বর্তমান থাকে। মানুষের মধ্যে সুপ্রবৃত্তি বেশির ভাগ সময় কাজ করে; কিন্তু কোনো মন যখন কোনো সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠে, তখন কুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ কারণে সমাজে নৃশংস অপরাধের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া নানা কারণে দুশ্চিন্তা থেকে হতাশা তৈরি হয়। ফলে সন্ত্রাস, মারামারি ও হত্যার মতো দুর্ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়ে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অতি উৎসাহী হয়ে অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অপরাধ প্রতিরোধের ব্যাপারে পরিবারকে তার সন্তানের নৈতিকতাবোধ শিক্ষা দেওয়ার জায়গাটা পাকাপোক্ত করতে হবে। শিক্ষককে, সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষকেই নৈতিকতাবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সমাজের কোনো জায়গায় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় সামাজিক অবস্থা কতটা দুর্বল, কতটা শঙ্কার। এই শঙ্কা মুক্তির জন্য মানুষকে সংগঠিত হতে হবে, একই সঙ্গে সংঘটিত সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্তমূলক কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। নতুবা এই অবস্থা কোনো একটি সমাজে চলতে থাকলে সেখানে আইনের শাসনের পরিবর্তে রাজনৈতিক শক্তির পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক অপরাধ তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ এখন নানাকেন্দ্রিক অস্থিরতাসহ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকালে সংঘটিত অপরাধের দ্রুত বিচার কার্যকর সমাধান হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমাজের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পুলিশের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের সব সচেতন নাগরিকের উচিত এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা।