
যার সন্তান মরে গেছে কিংবা শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি পুড়ে যাওয়ার ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, সেই মা-বাবার অনুভূতি বোঝার সাধ্য অন্য কারো নেই।
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরটা রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর দিন। ওই ক্যাম্পাসের একটি ভবনে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে-এমন সংবাদ শোনার পর উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা ছুটে যান। তাদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। কেমন আছে প্রিয় সন্তান! বেঁচে আছে তো?
এদিন একটি টেলিভিশনের খবরে দেখানো হয়-একেকটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর তার পেছনে ছুটছেন ভীতসন্ত্রস্ত মা-বাবা। হয়তো ওই অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই আছে তার বুকের ধন। কিন্তু সন্তানের দেখা না পেয়ে আবারও ফিরে আসেন স্কুলের সামনে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি অন্যতম বড় বিমান দুর্ঘটনা। যদিও বিমানের ভেতরে পাইলট একাই ছিলেন। নিহতদের সবাই ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। গত মঙ্গলবার সকালে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ২৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে, যাদের মধ্যে ২৫ জনই শিশু। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে যে ৭৮ জন ভর্তি আছে, তাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। ফলে এই মৃত্যুর মিছিল আরো দীর্ঘ হতে পারে।
এই মৃত্যু ও শোকের ভেতরেও যে আলোচনাটি সোমবার থেকেই সামাজিক মাধ্যমে বেশ জোরালোভাবে উঠে এসেছে তা হলো, রাজধানী ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরে কেন যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে? এই প্রশ্ন শুধু সাধারণ নাগরিক বা বিশেষজ্ঞরাই নয়, বরং রাজনৈতিক মহল থেকেও উঠেছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বলছে, সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই বিমানটি ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। যদিও পাইলট এটিকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
বাস্তবতা হলো, ঢাকা শহরের ওপরে কোনো বিমান উড্ডয়নের পরে তাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে সেটি জনবিরল এলাকায় নিতে নিতে যেখানে গিয়ে বিধ্বস্ত হবে, সেটিও জনপদ। কেননা এই শহরের আশপাশেও এখন গড়ে উঠেছে শহর, উপশহর। সবাই রাজধানীতে থাকতে চায়। বছরের পর বছর যে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়, সে বিষয়ে রাজনীতিবিদ বা আমলা কারোরই আগ্রহ নেই। ফলে কোস্ট গার্ডের সদর দপ্তরও এই শহরে রাখতে হয়। ক্যান্টনমেন্ট, বিজিবির সদর দপ্তর সবই ঢাকা শহরে। কিন্তু এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পুরো দেশকে একটি শহরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলে তার কী পরিণতি হয়!
বিমানের প্রশিক্ষণ চালানো হয় সাধারণত জনমানবশূন্য পাহাড়ি অথবা সমুদ্র এলাকায়। কিন্তু যে ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল শহর, যেখানে দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস, সেখানে এই ধরনের প্রশিক্ষণ মানেই হলো মৃত্যুর ঝুঁকি। ফলে সোমবার এই বিমানটিই যদি ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত না হয়ে বঙ্গোপসাগর বা পাহাড়ের কোনো নিরিবিলি এলাকায় গিয়ে পড়ত, তাহলে ন্যূনতম ক্ষতি হতে পারত। ক্লাসরত কোমলমতি শিশুদের জীবন এভাবে নিভে যেত না। সুতরাং তাদের মৃত্যুর জন্য ত্রুটিপূর্ণ বিমান যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী রাষ্ট্রের সিস্টেম।
প্রশ্ন উঠেছে, দেশে যুদ্ধবিমান বা অন্য যেকোনো বিমান প্রশিক্ষণের পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থাটি কি যথেষ্ট আধুনিক? উড্ডয়নের আগে কি প্রতিবার সঠিকভাবে এর সব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হয়? বারবার একই ঘটনা ঘটলেও কি কেউ ভুলের দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন বা গাফিলতির জন্য কারো শাস্তি হয়েছে? অর্থাৎ কাউকে কি জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে, নাকি প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করেই রাষ্ট্র তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়?
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনও বলেছেন, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ প্রশিক্ষণ কোন কোন এলাকায় হওয়া উচিত তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে। মঙ্গলবার হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা শহর ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে এটা ভাবতে হবে। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরো বলেন, পাইলটের ভুল বা কারিগরি সমস্যার কারণে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হতে পারে। তবে উত্তরার ঘটনায় ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার না করা পর্যন্ত বিস্তারিত বলা ঠিক হবে না।
মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বিপুল প্রাণহানির পর শুধু জনবহুল শহরে বিমান প্রশিক্ষণের বিষয়টিই নয়, বরং সামনে আসছে প্রশিক্ষণের জন্য যেসব বিমান ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর ফিটনেস নিয়েও। যারা এই বিষয়গুলো জানেন বোঝেন, তাদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বেশ পুরোনো, আনফিট বা ত্রুটিপূর্ণ বিমান কেন প্রশিক্ষণের কাজে লাগানো হবে? ত্রুটিপূর্ণ বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে একজন পাইলটসহ আরো অনেকের জীবনহানি ঘটানো হলো, তার দায় কে নেবে?
গত এক দশকে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ চলাকালীন বা রুটিন টহল অভিযানে। ফলে এবারের দুর্ঘটনার পরেও সামনে এসেছে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের কার্যক্ষমতা ও যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি। গণমাধ্যমের খবর বলছে, চীনের তৈরি এফ-৭ যুদ্ধবিমান একসময় অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য ছিল তুলনামূলক কম খরচে আকাশ প্রতিরক্ষার একটি সমাধান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ‘সাশ্রয়ী’ সমাধান আজ পরিণত হয়েছে বিপজ্জনক বোঝায়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইরানসহ আরো কয়েকটি দেশে ব্যবহার হওয়া এই বিমানটি এখন প্রায়ই শিরোনামে আসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার কারণে। জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে।
প্রশ্ন হলো প্রশিক্ষণে গিয়েই যে বিমানগুলো দুর্ঘটনার শিকার হয়, সেই বিমান যুদ্ধের সময় কী কাজে লাগবে? এ রকম দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ বিমান কেন বিমানবাহিনীর বহরে রাখতে হবে, যেখানে চীনের বিমানবাহিনীও ২০২৩ সালে এই যুদ্ধবিমানের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে বিমানগুলোর মধ্যে ধাতব ক্লান্তি (metal fatigue), ফাটল ও স্ট্রাকচারে দুর্বলতা তৈরি হয়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। যে কারণে এর আগেও বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর বহরে থাকা এই বিমানের একাধিকবার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া, হাইড্রোলিক সিস্টেম ফেল করা কিংবা রাডার সমস্যার কারণে মাঝ আকাশে সমস্যা তৈরি হয়েছে। শুধু পাইলটদের দক্ষতার কারণেই অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। কিন্তু প্রতিবারই এর পেছনে ধরা পড়ছে এক বা একাধিক যান্ত্রিক ত্রুটি।
ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার সকালে ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা। তাদের ৬ দফা দাবির মধ্যেও আছে বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল করে নতুন ও নিরাপদ বিমান চালু করা এবং বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ এলাকা মানবিক ও নিরাপদভাবে পুনর্বিন্যাস করার বিষয়টি। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে আরেকটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে কোনো ‘যদি কিন্তু’র সুযোগ নেই।