Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

রক্তঋণ শোধ করতে হবে

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪:২৮

রক্তঋণ শোধ করতে হবে

জুলাই অভ্যুত্থানের বিভিন্ন ঘটনা এখনো আমাদের চোখে ছায়া ফেলে। এখনো অনেক নাম মাথার ভেতরে যেন আটকে আছে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিদায় হলেও অজস্র তরুণের আত্মদান এখনো পিছু ডাকে। শহীদ মুগ্ধ, জয়, ফারহান ফাইয়াজ-কত শত নাম। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র শহীদ পরিবারগুলো যে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে, সেটা খুবই দুঃসহ। সারাজীবন এভাবেই তারা বাঁচবে এটা ভাবতেই ভাষাহীন হয়ে যেতে হয়। এসব শহীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এই ভয়াবহ নারকীয়তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। 

১৮ জুলাই, উত্তপ্ত রাজধানী। মহাখালীর তিতুমীর কলেজ থেকে গাজীপুর অবধি ছাত্রদের শাটডাউন চলছে। রোদ উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করছে উত্তরা-আজমপুর থেকে সারা দেশ। রাজধানীর উত্তরা-আজমপুর এলাকায় মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ পানির কেস হাতে নিয়ে ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিতরণ করছিলেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাসে তার চোখ হয়তো জ্বালা করছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর শেয়ার করা এক ভিডিওতেও দেখা গেছে, সেদিন অকুতোভয় মুগ্ধ কীভাবে সেবা দিচ্ছিলেন ক্লান্ত-শ্রান্ত আন্দোলনরত সব শিক্ষার্থীকে। এই ভিডিও যখন করা হয় তার মাত্র ১৫ মিনিট পর থেকেই তিনি আর কাউকে পানি দেননি, দিতে পারেননি। আন্দোলনকারীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গুলি চালালে একটি গুলি মুগ্ধর কপালে  এসে লাগে। তার সঙ্গে থাকা বন্ধুরা দ্রুত মুগ্ধকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান তিনি।  মুগ্ধর মৃত্যুর শোক থেকে ক্ষোভ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যে। দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতিতে আঁকা হয় পানির বোতল। পাশে লেখা ‘পানি লাগবে পানি’? মুগ্ধ হয়ে ওঠে পানির প্রতিশব্দ। অজেয় জীবনের আরেক নাম মুগ্ধ।

একই দিন। ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজের এইচএসসি ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ। সকাল  সাড়ে ১০টার দিকে বন্ধু জিদানের ফোন কল পেয়ে ঘুম থেকে উঠে কলেজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সাড়ে ১১টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তার মা অনেকবার বারণ করেছিল, কিন্তু তাকে আটকাতে পারেনি। ১টার একটু পর সে তার মায়ের কল রিসিভ করে বলেছিল ধানমন্ডির রাপা প্লাজার ওখানে লুকিয়ে আছে। তার মা তখনই বাসায় যেতে বলে। কিন্তু ওটাই ছিল শেষ কল, তারপর আর ফাইয়াজ ফোন ধরেনি। ধানমন্ডি ২৭-এর জেনেটিক প্লাজার সামনে ওর জুনিয়র ভাইদের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ করেই পুলিশ ও সশস্ত্র ক্যাডারদের ধাওয়াধাওয়ির মাঝে পড়ে যায় ফাইয়াজ। চারপাশে রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও গুলির শব্দে রণক্ষেত্রে পরিণত পুরো এলাকা। একপর্যায়ে গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। আনুমানিক ২টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় ফাইয়াজ। আড়াইটার দিকে ফাইয়াজের বন্ধু ওয়াসিফ তার বাবাকে ফোন করে জানায় সে কথা। ফাইয়াজের বাবা দ্রুত সিটি হসপিটালে ছুটে যায়। কিন্তু  তখন সব শেষ। এখন সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষায় কাটে পরিবারের প্রতিটি মুহূর্ত।

মাসুদ রানা মুকুল, ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় সনি সিনেমা হলের পেছনের দিকে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নিরলসভাবে সহযোগিতা করেছেন মুকুল। অন্য দিনের মতো ৪ আগস্ট পানির বোতল ও বিস্কুট নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় অবস্থান করছিলেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে একটি গুলি মুকুলের মাথার পেছন দিক দিয়ে ঢুকে বাম কানের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে ভর্তি করা হয়। রাত সোয়া ১টার দিকে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান মুকুল। শহীদ মাসুদ রানার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা অভিযোগ করেন, ‘আমাদের এক বছর কেউ মনে রাখেনি, আজ এক বছর পর মনে পড়ল? শহীদ পরিবার এখনো স্বীকৃতি পায়নি। এখনো বিচার হয়নি।’ কবে হবে তাও জানে না কেউ।

অন্যদিকে ২০ বছর বয়সী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ (জয়) কামারপাড়ারই বাসিন্দা, টঙ্গী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বিকেলেই বন্ধুদের সঙ্গে জয় যুক্ত হয়েছিলেন, ১৮ জুলাই যুক্ত হয়েছিলেন গণ-আন্দোলনে। সেখানে আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তারা। মায়ের সঙ্গে তখনো তার যোগাযোগ হচ্ছিল। শেষবার যখন কথা হয়, ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা বেজে ৩২ মিনিট। আর তারপরের পাঁচ মিনিট, মাত্র পাঁচ মিনিট...বিকেল ৫টা ৩৭ মিনিটে জয়কে মাথায় গুলি করে হত্যা করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নেওয়া হয়। নেওয়ার পরই চিকিৎসকরা জানান, জয় ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছেন। জয়ের মৃত্যুর খবর যখন প্রথম তার বাসায় যায় সেই শোকাবহ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে জয়ের বড় বোন শাহানাজ আহমেদ শিমু বলেন, ‘পরিবারের সবাই তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, কান্নাকাটি করা যাবে না। কারণ পুলিশ ব্লক রেইড দিচ্ছে, লাশ নিতে দেবে না। স্বাধীনভাবে কাঁদতেও পারিনি আমরা।’ এমনকি জানাজার পরও জয়ের লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। কিন্তু এলাকাবাসীর কারণে তা সম্ভব হয়নি। সেদিন সন্ধ্যার পরই শহীদ মুগ্ধর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় শহীদ রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ জয়কে। 

এমন অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদ বিদায় হলেও আজও শহীদের পূর্ণাঙ্গ একটি  তালিকা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এই আন্দোলনের শহীদদের বিচারের কোনো লক্ষণ দেখছি না আজও। কিন্তু বিকাশের আগেই যারা এসব তরুণকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার না হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না কখনো। 

আমরা এসব শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাই। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এই রক্তঋণের ক্ষতচিহ্ন রয়ে যাবে। তাদের শহীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হতে হবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা না হলে জুলাই অভ্যুত্থানের রক্তঋণ শোধ হবে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫