Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

‘মব জাস্টিস’ নিয়ে কিছু কথা

Icon

জয়নাল আবদীন

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৩:০৩

‘মব জাস্টিস’ নিয়ে কিছু কথা

ইদানীং মব জাস্টিসের পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের মিডিয়ায়, টক শো থেকে গ্রামের টি স্টল পর্যন্ত আলাপ-আলোচনার তুমুল ঝড় বইছে। মব জাস্টিস বা গণপিটুনি বা গণধিক্কার বা গণতিরস্কার কখন কীভাবে আমাদের সমাজজীবনে ঢুকেছে, তার যথাযথ ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এর শিকড় সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক গভীরে প্রোথিত। গড়ন (মব) একটি ইংরেজি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ উচ্ছৃঙ্খল জনতা বা গুন্ডাদল কর্তৃক হামলা বা সহিংসতার জন্য ঘিরে ফেলা। মবের সঙ্গে জাস্টিস শব্দটি একেবারেই বেমানান। জাস্টিস হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনি কাঠামোর ভেতর দিয়ে কোনো মানুষের অপরাধজনক কর্মের জন্য আইন নির্ধারিত শাস্তির ব্যবস্থা করা। মব জাস্টিস আইনি নিয়ম কানুনের ধারেকাছেও থাকে না। এক দল উচ্ছৃঙ্খল জনতা উত্তেজিত হয়ে অথবা পরিকল্পিতভাবে বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফলে কোনো অপরাধী বা নিরপরাধ মানুষকে (সেই মানুষ পুরুষ বা নারী হতে পারে)। বেপরোয়া মারধর, মেরে ফেলা অথবা নানাভাবে অপমান-অপদস্ত, তিরস্কার, গলায় জুতার মালা পরানো, মাথা ন্যাড়া করা, বিবস্ত্র করে জনসম্মুখে তাড়া করা। সেই ব্যক্তি অপরাধী না নিরপরাধী আইনি প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই তার বা তাদের বিচারের নামে জঘন্যভাবে অবিচার হয়ে যাওয়া। 

মাঝেমধ্যে শুনি গ্রামবাসী পিটিয়ে ডাকাত, চোর, গরু চোর মেরে ফেলেছে। অসামাজিক কাজের জন্য কোনো নারী বা পুরুষের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে। জুতার মালা গলায় দিয়ে পাড়া-মহল্লা ঘুরিয়েছে, কোনো পরিবারকে এক ঘরে করেছে। এসব মব জাস্টিস আদি কাল থেকেই আমাদের সমাজে আছে। তবে নিরীহ, কড়িহীন, গরিব অসহায় ক্ষমতাহীন মানুষের উপরই এমন অবিচারের খড়্গ মাত্রাতিরিক্ত হয়। আমরা অনেক সময় এটাকে সামাজিক বিচার বলে থাকি। সম্ভবত ২০১৯ সালের দিকে ঢাকার কোনো এক জায়গায় রেনু নামের এক মহিলাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এমন ঘটনা আমাদের গ্রামে-গঞ্জে, 

শহরে-বন্দরে হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায়। এই যে আমরা রাস্তায় ছিনতাইকারী, বাসে পকেটমার, মলমপাটি সন্দেহে কাউকে ধরি, তাকে গণধোলাই দিতে কখনো পিছ পা হই না। কিন্তু আমাদের সমাজে এসব ঘটনা কেন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে তার গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। কোনো কিছু বাছ-বিচার না করে গুজবে বিশ্বাস করে, কারো দ্বারা উত্তেজিত হয়ে একজন অপরাধীকে (সেই মানুষটি নিরপরাধ হতে পারে) আইনের হাতে সোপর্দ না করে নিজেরাই যথেচ্ছভাবে বিচার করা কেন? 

আমাদের সমাজে মব জাস্টিস তিনভাবে দেখা যায়। প্রথমত, জনতা বা সামাজিক মানুষের দ্বারা মব জাস্টিস। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের দ্বারা সংঘটিত মব জাস্টিস। ইদানীং রাজনীতিতেও মব জাস্টিস ঢুকেছে বীরদর্পে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মব জাস্টিসের জন্য বহুলাংশে দায়ী। রাষ্ট্র অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করবে-এটাই স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু রাষ্ট্র যখন নিজেই নানা যুক্তি দাঁড় করিয়ে মব জাস্টিস করে, তখন মানুষ বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে নিজেদের শামিল করে। 

ক্রসফায়ার নামে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহার করে অপরাধ প্রমাণের আগেই কাউকে মেরে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের রাষ্ট্র্র ক্রস ফায়ার তকমা দিয়ে যত মানুষকে হত্যা করেছে, তারা কি সবাই অপরাধী ছিল? অপরাধী হলেই বা কি, বিচারের জন্য আদালত আছেন। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে রাষ্ট্র্র নিজের ব্যর্থতা আড়াল করতে ক্রস ফায়ার নামের এক ধরনের মব জাস্টিস চালু করেছে। যেখানে রাষ্ট্র্রীয় মদদে ক্রস ফায়ার বা মব জাস্টিস হয়, তাকে আমরা কী করে সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিই। এরশাদ সরকারের পতনের পর সেই আন্দোলনের অগ্রসৈনিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে রাজনৈতিক মব জাস্টিসের হাতে খড়ি হয়। এরশাদের পতনের পর জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী, তাদের আত্মীয়স্বজন, বাড়ি-ঘরে হামলা-লুটপাটের এক মহোৎসব আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বিএনপি আর আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন অথবা পুলিশে সোপর্দ করা থেকে বেঁচে ছিলেন। নব্বইয়ে আমাদের ছাত্ররাজনীতির যে গৌরবগাথা ছিল, তা আদর্শ শূন্য হয়ে টাকার কাছে বিক্রি হওয়া শুরু করল এভাবেই। যেটা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। ছিয়ানব্বইয়ে বিএনপি বিদায় নিলে তাদের অবস্থাও জাতীয় পার্টির মতোই হয়। তাদের নেতাকর্মীদের রাস্তাঘাটে মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুর, ধরে ধরে থানায় সোপর্দ করা হলো। কিন্তু যাকে থানায় সোপর্দ করা হলো, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাই নেই। আমাদের করিতকর্মা পুলিশ প্রশাসন তার বা তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দিয়ে জেলে পাঠাল। এবার মাঠের খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ দোর্দণ্ড প্রতাপে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করল। ২০০১-এ ক্ষমতার পালাবদল হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ভাগ্যেও একই পরিণাম হলো। আজ-অবধি ক্ষমতার পালাবদলের পর আমরা যে মব দেখে আসছি, সেটা কি আমাদের রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় রেখেছে? নাকি জমিদারের লাঠিয়াল দিয়ে চর দখলের মতো অসভ্য রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত করেছে?

সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে বিএনপির কর্মীরা জুতার মালা পরিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে, কারণ তিনি ডামি নির্বাচন করেছেন। আমার প্রশ্ন অন্যখানে। বিএনপির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে এমনিই পুলিশ গ্রেপ্তার করত। বিএনপির নেতাকর্মীদের তাকে জুতার মালা গলায় দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন? ডামি নির্বাচন দিনের ভোট রাতে, ভোটারহীন নির্বাচন, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, মহিলা বুথে পুরুষের সিল মেরে ভোটের বাক্স ভর্তি করা-এসব দেশের ভোটের রাজনীতিকে অক্টোপাসের মতো বেঁধে রেখেছে। দেশে যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতার পাল্টাপাল্টি করে তাদের কেউ কমবেশি এসব অভিযোগের দায় থেকে মুক্ত নয়। আওয়ামী লীগও ভেবেছিল তাদের কেশাগ্র কেউ ছুঁতে পারবে না। বিধিবাম, প্রকৃতিই তার বিচার করল। বিএনপি হয়তবা ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে, কিন্তু তাদের কাণ্ডকীর্তন যদি সেই আওয়ামী লীগের মতোই হয়, তাদের স্মরণ রাখতে হবে জুতার মালা বুমেরাং হতে খুব বেশি সময় লাগে না।


লেখক : আইনজীবী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫