
নিজের সুরক্ষা চেয়ে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী ঢাকার আদালতে মা ও বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মেহরীন নামের এক কিশোরী। পরে বিচারক বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করে তার মা ও বাবাকে আদালতে হাজিরের জন্য সমন জারি করেন। মামলা শেষ পর্যন্ত চলবে কি না, মেহরীন ও তার পরিবার আদালতের বাইরে একে সমাধান করতে পারবে কি না, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এ কথা নিশ্চিত, এই ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, পরিবারের ভেতরেও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হতে পারে, যদি সম্পর্কের যত্ন না নেওয়া হয়।
এই ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি দেখা গেছে। কেউ কেউ দায়ী করেছেন মা-বাবার ভুল প্যারেন্টিংকে। কেউ আবার পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন, যেখানে সন্তানরা বড়দের শ্রদ্ধা ও সম্মান এবং ছোটদের স্নেহের মমতার বন্ধন থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। আমার মনে হয়েছে-
অবশ্যই এই মা-বাবার প্যারেন্টিং সঠিক ছিল না। সঠিক প্যারেন্টিং হলো এমন এক ধরনের অভিভাবকত্ব, যেখানে সন্তানকে ভালোবাসা, বোঝাপড়া, নিয়মতান্ত্রিকতা ও ইতিবাচক অনুশাসনের মাধ্যমে বড় করে তোলা হয়। সঠিক প্যারেন্টিং সন্তানকে শুধু শিক্ষিত করে তোলে না, বরং সঠিক মূল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস ও সমস্যা মোকাবিলার ক্ষমতাও প্রদান করে।
এই ক্ষেত্রে মা-বাবার কোনো একজন হয়তো বেশি শাসনে রেখেছিলেন এবং অন্যজন মেয়েকে বোঝার চেষ্টা না করে তাকেই সাপোর্ট করেছেন। অন্যদিকে হয়তো কিছু কাছের মানুষ, আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তি মেয়েটিকে উসকে দিয়েছে মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করতে।
সমস্যা হলো, অনেক মা-বাবার কাছেই সন্তান যেন একটা সম্পত্তি। ভাবখানা এ রকম-সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সুতরাং তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করতে পারবেন। অথচ মনোবিদরা বলেন, সন্তানকে মেরে, বকা দিয়ে, অভিযোগ করে কখনো ভালো ফল হয় না, বরং খারাপটাই হয়। সন্তানের সঙ্গে ঠান্ডাভাবে, বুঝিয়ে কিছু বললে সেটা ইতিবাচকভাবে কাজ করে। সন্তানকে বুঝতে হবে, ওদের বন্ধু হতে হবে, তাহলেই সহজ হবে দিন। সময় দিতে হবে সন্তানকে। আমি নিশ্চিত, মেয়েটার বাবা যখন মেয়েকে শাসন করেছেন, তখন হয়তো সেই মা-ও বাবাকেই সমর্থন করেছে, সঙ্গে মেয়েকেও বকা দিয়েছেন। এতে মেয়েটা মানসিকভাবে আরো বেশি একা হয়ে গেছে।
মেয়েটা বলেছে আমার জন্ম হয়েছে তাদের ইচ্ছাতেই (আরো ডিটেইলস বলেছে মেয়েটা, আমি ততটা বললাম না এখানে)। এটা বাচ্চারা তখনই বলে যখন খুব বেশি নেগেটিভ চিন্তা হয় মা-বাবা সম্পর্কে। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি সন্তান খারাপ কিছু চাইলে বা করলেও আমরা কিছুই বলব না? আমার উত্তর বলবেন অবশ্যই। তবে পজেটিভভাবে নেগেটিভ কথাটা বলতে হবে, রাগ বা মারধর করে না।
সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠুন
টিন এজ সময়টা ভীষণ নাজুক, একবার খারাপ পথে গেলে ভালো পথে ফিরিয়ে আনা ভীষণ কঠিন। জেনারেশন গ্যাপও একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর আপনার উপর যদি সন্তানের নেগেটিভ ধারণা একবার হয়, তাহলে আর কখনোই সে আপনার কথাকে গুরুত্ব দেবে না।
আত্মহত্যার প্রবণতা আমাদের সমাজে বেড়েই চলেছে। সন্তান যখন বাবা বা মায়ের থেকে বেশি শাসন আর কম ভালোবাসা পায়, তখন অনেকেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে আমি বলব এই মা-বাবার ভাগ্য ভালো মেয়েটা সেদিকে যায়নি বা সেই ঐশির মতো মা-বাবাকে মেরে ফেলতে চায়নি।
সন্তান যত খারাপ কাজ করুক, অযৌক্তিক দাবি করুক, মা-বাবার উচিত বাচ্চার আগে বন্ধু হয়ে তার সমস্যা শুনতে হবে। সন্তানের সকল অবস্থায় পাশে থাকুন, দেখবেন ভালো ফলাফল আসবেই। মা-বাবার সাধ্য কতটুকু সেটা সন্তানকে বোঝাতে হবে।
পারিবারিক পরিবেশ
একটি সন্তানের মানসিক গঠন তৈরির ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং স্নেহময় পরিবেশে সন্তান বেড়ে ওঠা জরুরি। যে পরিবারে মা-বাবা সন্তানের সামনেই দুজনে ঝগড়া বা তর্ক করেন, পরস্পরের প্রতি অসম্মানজনক, অভব্য আচরণ দেখান, সেই সন্তানরাও মা-বাবাকে সম্মান দিতে শেখে না।
আমি এমন তিন বাবাকে দেখেছি, যাদের সন্তানের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাবাকে বাবা বলে স্বীকার করে না, বাবা বলে ডাকেও না, সঙ্গেও থাকে না। বদরাগী বাবাকে যদি মা সাপোর্ট করে, আর বদরাগী মাকে যদি বাবা সাপোর্ট করে তখন সন্তান একা হয়ে যায়। আর তখনই দুর্ঘটনা ঘটায়।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, অনেক সময় সহানুভুতি পাওয়ার জন্য মা-বাবা পরস্পরের সম্পর্কে খারাপ বা নেগেটিভ কথা বলে বাচ্চাদের। এতে সাময়িক সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে বাবা বা মায়ের প্রতি ক্ষোভ জন্মায় বাচ্চার। তাই মা-বাবাকে একজন আরেকজন সম্পর্কে কখনই বাচ্চার কাছে নেগেটিভ কথা বলা যাবে না। বাচ্চারা
মা-বাবার কাছ থেকে সব সময় আদুরে, আহ্লাদি ভাষা আশা করে। যেমন-আমি নিজে এই বয়সেও আশা করি বাবার কাছ থেকে আদুরে কথা আর একমুঠো ভালোবাসা।
যা করতে হবে
যদি কখনো মনে হয় বন্ধুবান্ধব বা অন্য কোনো কারণে আপনার সন্তানের মানসিক সমস্যা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াটিস্টের কাছে যান। কাউন্সেলিং করান বাচ্চার। মা-বাবারও কাউন্সেলিং দরকার এ সময়। কারণ আমরা নিজেরাই বুঝি না আমাদের বা বাইরের কোনো কারণে সন্তানের পরিবর্তন বা সমস্যা হচ্ছে।
প্রকৃতির নিয়ম-কর্মের ফল আসবেই। সন্তানকে বেশি বেশি সময় দিন, ওদের মতো করে ওদের বোঝার চেষ্টা করুন, সব অবস্থায় পাশে থাকুন আর বেশি বেশি ভালোবাসুন। দেখবেন সন্তান আপনার হাতের মুঠোয়। যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই চলবে। মা-বাবাকে হতে হবে আপাত কঠিন, কিন্তু আসলে নরম। নইলে-
১. ঐশির মতো ঘটনা ঘটবে। মা-বাবাকে খুন করবে।
২. নিজেই সুইসাইড করবে সময় বুঝে, যেটা মা-বাবা টেরও পাবেন না।
৩. মেহরীনের মতো বিশ্বকে জানাবে তার বুকের ভেতর জমানো কষ্ট।
৪. সন্তান উগ্রবাদী হবে, বিশৃঙ্খল জীবন যাপন করবে এবং মা-বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে প্রতিদিন, পড়াশোনা গোল্লায় যাবে।
পারিবারিক পরিবেশে সম্পর্কের অবহেলা বা মানসিক দূরত্বই অনেক সময় এমন চরম সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়, যা সমাজের জন্য একটি সতর্কবার্তা।