Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

দুর্নীতি নির্মূল প্রায় অসম্ভব

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৪:২৪

দুর্নীতি নির্মূল প্রায় অসম্ভব

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ শাসনামলের দুর্নীতির উপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। শ্বেতপত্র বলছে, গত ১৫ বছরে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই শ্বেতপত্র তৈরি করেছেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু সমস্যা হলো তিন মাসে ৪০০ পৃষ্ঠার দুর্নীতির ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা হলো, কিন্তু শ্বেতপত্রের বয়স ছয় মাস পার হলেও সরকার একজন চোরও ধরতে পারল না। আওয়ামী লীগ সরকার চোর ধরা শুরু করেছিল, আইজিপি বেনজীর আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতিউর রহমানের দুর্নীতির খতিয়ান মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারও করেছে। শুধু বেনজীর আর মতিউর এই দুজনই কি ২৩৪ বিলিয়ন ডলার চুরি করেছেন? চোর তো আরো আছে!  

গত ১৫ বছরের দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে সময় নষ্ট করার সময় এখন অন্তর্বর্তী সরকারের নেই, এই অবস্থায় তারা অন্তত তাদের আমলের চুরি ও ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করুক-এতেই দেশ অনেকটা শুদ্ধ হয়ে যাবে। জিরো টলারেন্সের কঠোর নীতির মধ্যেই শেখ হাসিনার বাসার পিয়ন চারশ কোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের জিরো টলারেন্সের ভেতর উপদেষ্টাদের পিএ বা পিএসদের দুর্নীতির যেসব গল্প মিডিয়ায় এসেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। বিএনপিও জিরো টলারেন্সের কথা বলছে; ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি।  জামায়াতে ইসলাম সৎ লোকের শাসন চায়, জিরো টলারেন্সের কথা বলেছে কি না জানি না। মনে রাখা দরকার, জিরো টলারেন্সের নীতিতে বিশ্বাসী বিএনপির আমলেও দেশ পাঁচ পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।  

আওয়ামী লীগ তাদের আমলে পাচার হওয়া একটি টাকাও ফেরত আনার চেষ্টা করেনি। করার কথাও নয়। কোনো সরকার তাদের আমলের ঘুষ আর দুর্নীতি শনাক্ত করে না। আওয়ামী লীগ শুরু করেছিল, শেষ করেনি। ক্যাসিনো কাণ্ডের পর দুর্নীতি উচ্ছেদের কাজ হঠাৎ থেমে যায়। ক্ষমতায় থাকাকালীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলীয় সরকারের শক্ত অবস্থান না থাকায় ঘুষ আর দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। ক্ষমতাচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত দুদক ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির নিশানাও খুঁজে পায় না, কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পরদিনই শুরু হয় দুর্নীতির ফিরিস্তি। এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলেই তারা সমস্বরে বলতে থাকবে, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’। একই কথা এতদিন বলেছে বিএনপি।  

ক্ষমতায় বসেই দলীয় সরকারের প্রধান কাজ তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার। সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসেই প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, বিএনপিও একই কাজ করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিএনপি-জামায়াত উভয় দলের অনেক মামলা নির্বাহী আদেশে এরই মধ্যে নিষ্পন্ন হয়ে গেছে বা যাবে। তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলা যে হয় না তা কিন্তু নয়, বিরোধী দলকে হেনস্তা করার সব উপকরণ সরকারের অধীনে থাকে বিধায় সরকার ইচ্ছা করলেই বিরোধী দলের শীর্ষ নেতার কোমরেও পিস্তল, হিরোইন গুঁজে দিতে পারে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফেরির ‘প্লেট চুরির’ অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছিল। সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে সব মামলা প্রত্যাহারের এই প্রবণতা যতদিন থাকবে, দেশ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, অপরাধ দূর হবে না।  

ঘুষ, দুর্নীতি এখন জাতীয় ব্যাধি, এর চিকিৎসা কেউ চায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও একই কথা বলেছেন, তার বক্তব্য হচ্ছে রাজনীতিবিদ, আমলা কেউই চায় না দুর্নীতি বন্ধ হোক। তিনি অপচয় ও অদক্ষতার কথাও উল্লেখ করেছেন। পরিকল্পনা উপদেষ্টা নরম মানুষ, যা বলেছেন তা হলো দেশে ঘুষ-দুর্নীতি বহাল তবিয়তে আছে। তিনিও বিদ্যুৎ উপদেষ্টার মতো অপচয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রদত্ত অপ্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাদ বা কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হলেই প্রশাসনে অস্থিরতা বেড়ে যাবে। এই অস্থিরতার ভয়ে প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। তাহলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও তো সামাল দিতে পারছেন না। দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে সংস্কারের নামও কেউ মুখে নেবে না। কারণ তখন দলীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর ক্ষমতা হবে অপ্রতিরোধ্য। কোনো কর্মকর্তা শ্রমিকদের কথা না শুনলেই ট্যাগ লাগানো হবে ‘স্বৈরাচারের দোসর’। 

অন্তর্বর্তী সরকার শুধু গত ১৫ বছরের দুর্নীতির কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো আগেও দেশ শাসন করেছে, তখন কি দুর্নীতি হয়নি? অন্তর্বর্তী সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কথা শুনলে মনে হয়, শুধু আওয়ামী লীগের লোকদের প্রশাসন থেকে সরিয়ে দিলে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল হয়ে যাবে। তাই যদি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতীতি হয় তাহলে বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ উপর্যুপরি পাঁচ-পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হলো কি করে! একই কথা সমভাবে প্রযোজ্য আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও-এই দুটি দলের কর্মী-সমর্থকরাও বিশ্বাস করেন না যে তাদের দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা চুরি করতে পারেন, ঘুষ খেতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন, জনগণ ‌‘টাকা খেয়ে ভোট দেয়’। দলীয় প্রতীকে দলকানা এবং টাকার ভোটের আধিক্যের কারণেই দুর্নীতিবাজরা বারবার নির্বাচিত হন, মনোনয়নও দেওয়া হয় দুর্নীতিবাজদের। 

ঘুষ আর দুর্নীতির সংস্কার কোনো সরকারই করেনি, করবেও না। অন্যদিকে সংস্কার যতই করা হোক, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হবে না, পাচার করা টাকা ফেরতও আসবে না। ঘুষ ও দুর্নীতি দেদার হলে অতিরিক্ত অর্থ বিদেশে পাচারের প্রয়োজন হয়, কারণ দেশে এত বেশি টাকা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেই। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের আমলে এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের পরিচালক ছিলেন, তিনি ঘুষদাতাকে কোনো ইতস্তত না করেই তার বিদেশি অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়ে দিতেন-গল্পটি শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাবেক ডেপুটি গভর্নর প্রয়াত আল্লাহ মালিক কাজেমীর মুখে। তিনি আরো একটি কথা বলতেন, আইন যত কঠোর হয়, ঘুষ আর দুর্নীতি তত বাড়ে।  বিদেশে পাচার করা সব টাকা ঘুষ বা দুর্নীতির নয়, এর মধ্যে সততার মাধ্যমে উপার্জিত টাকাও আছে। নিজের অর্থ বিদেশে নেওয়া নিষিদ্ধ বলেই পাচার করা সব অর্থকে অবৈধ বলা হচ্ছে; কিন্তু ধনী দেশগুলোতে এমন নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বিদেশে সব নাগরিকই অর্থ কোনো অনুমতি ছাড়াই নিতে পারেন, বিদেশে অর্থ নেওয়াকে তারা পাচার বলে না, অবৈধ বলে না।  

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দুর্নীতি হয়; সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্ব দমাতে হলে জ্ঞাতসারে দুর্নীতি করার সুযোগ দিতে হয়।  দুর্নীতিবাজ না হলেও দুর্নীতিবাজ বানাতে সরকারের বেশি সময় লাগে না। আওয়ামী লীগ আমলে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের আয়কর নথি নিয়ে কয়েকবার টানাটানি হয়েছে, আয়কর নথি নিয়ে টানাটানি হলেই তারা বিনা শর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ রেখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আন্দোলনরত কয়েকজন নেতার ফাইল নিয়েও নাকি টানাটানি হয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণ শতভাগ ঠিক। নির্বাচন মানেই টাকার খেলা। দেশব্যাপী ঘুষ আর দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। চোরও চুরির বিচার চায়, ধর্ষকও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আরো একটি লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে জাতীয় ফল মেলার উৎসবে। গণভবন এবং ফল লুটে ছিল না কোনো না-খাওয়া মানুষ, ছিল না অনাহারক্লিষ্ট কঙ্কালসার ভবঘুরে, ছিল না ভাতমাগনা গরিব-দুঃখি-ভিক্ষুক; ছিল প্যান্ট-শার্ট-পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা সুপুরুষ এবং দামি শাড়ি-কামিজ পরা নারী। এদের অনেকেই ছিল দেশের সেরা মাদ্রাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, সাংবাদিক, উকিল, ব্যবসায়ী, আলেম, ইমাম ও মুয়াজ্জিন। সুযোগ পেলে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ শুধু গণভবন আর ফল মেলায় চুরি করে না, তারা ক্ষমতা পেলে রাজার আসনে বসেও চুরি করে। এই দেশে দুর্নীতি আর চুরি কখনোই বন্ধ হবে না, কারণ ক্ষমতায় থাকলে চোরও সাধু, ক্ষমতা হারালে সাধুও চোর হয়ে যায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫