গণ-আন্দোলনের পর নানা রাজনৈতিক এজেন্ডার মানুষ

মীর হুজাইফা আল মামদূহ
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০২

গত বছর ৪ আগস্ট আমি ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে ছিলাম চাকরি সুবাদে। সেখানকার একটা অফিসে কাজ করতাম। ঠিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখলাম আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এসে গোটা ২৭ নম্বর রোড দখল করে নিল। বেশ কয়েকজনের হাতে বন্দুক, একজনের হাতে এ কে সিরিজেরও একটা বন্দুক দেখলাম। আমরা ছবিও তুললাম বেশ কিছু। মিছিল করছিল না তারা, বরং মহড়া দিচ্ছিল, মিছিলের ঠিক মধ্যখানে একটি গাড়ি, সেটা সম্ভবত অস্ত্রে বোঝাই। মোহাম্মদপুরের দিকে আন্দোলন হচ্ছিল, সেই আন্দোলনে গুলিও ছুড়তে দেখেছি বেশ কয়টি। এত এত অস্ত্রের মহড়া দেখে একটু দমেই যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল শিগগিরই কি হাসিনার পতন হবে? কিন্তু পতন যে এতটা ঘনিয়ে আসছিল, টের পাইনি! পরদিনই তো পালিয়ে বাঁচলেন ‘খুনি ভদ্রমহিলা’।
হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে ইন্টেরিম সরকারের শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত মাঝের এই সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ যেকোনো প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতনের পরই একটা বড় রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, খুনোখুনি-নৈরাজ্য ছড়িয়ে যায়, ফরাসি বিপ্লবের তুলনা দেওয়া হয় এই ক্ষেত্রে। কিন্তু সেটা অনেক আগের, খুব নিকট অতীতেও এর প্রমাণ আছে অনেক, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরেও একটা বড় ধরনের নৈরাজ্যের সময় গেছে। আরব বসন্তের পর এখনো অনেক দেশ ঠিক করে গুছিয়ে উঠতে পারেনি, মিসরে সেনা সরকার চলছে, লিবিয়ায় দুটি সরকার ক্ষমতায়। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে একটা দীর্ঘ যুদ্ধের পর এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
আন্দোলনের পর এমন নৈরাজ্যের দেখা দেওয়ার অনেক কয়টা কারণ থাকে, প্রথমত, যখন কোনো স্বৈরশাসক দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে, তখন সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে এমন কাউকেই দাঁড়াতে দেয় না, ফলে রাষ্ট্র নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা সরকারও তাই করেছিল আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। নেতৃত্ব গড়ে উঠতে দেয়নি, যার মধ্যেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাকেই নানাভাবে হয়রানি, মামলা, হেনস্তা করেছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৬০ লাখ মামলা চলমান ছিল সেই সময়ে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়। কারণ যেকোনো আন্দোলন যখন গণ-আন্দোলন হয়ে ওঠে, সেখানে শুধু একটি রাজনৈতিক এজেন্ডার মানুষ থাকে না, বরং নানা ধরনের রাজনৈতিক এজেন্ডার মানুষ সেখানে যোগ দেয়। কারণ ভিন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রায় সবাই সেই স্বৈরশাসনের নিগ্রহের শিকার হয়েছিল কিংবা তার ক্ষমতা দখলের ইচ্ছাও থাকে। আর প্রতিটি মতাদর্শের লোক তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমে যায়, ফলে হানাহানি তৈরি হয়। আমাদের জুলাই আন্দোলনেও তা-ই ঘটেছিল, সেখানে যেমন বিএনপি এসেছে, জামায়াতও এসেছে। একই সঙ্গে যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেন, তারাও যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন এমনকি যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই মানেন না, বরং শরিয়াভিত্তিক শাসন চান তারাও। তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা অবশ্যই এক ছিল না, বরং নানা এজেন্ডা নিয়েই তারা আন্দোলনে নেমেছেন, আন্দোলন সফল করেছেন।
তৃতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আর সেই অবনতির সুযোগ নেয় লুটেরারা। তারা দেশে অস্থিরতা তৈরি করে। জুলাই আন্দোলনের পর পুলিশ বাহিনী প্রায় লুপ্তই হয়ে গিয়েছিল, কারণ গোটা পুলিশ বাহিনী সরকারের রক্ষক হিসেবে কাজ করেছে, সরকারে খুনি বাহিনী হিসেবে আন্দোলনে নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। যার ফলে আন্দোলনের পর পুলিশ বাহিনী বেকায়দায় ছিল, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, পুলিশ ছিল প্রথম কিছুদিন।
আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের অস্থিরতা তৈরির এসব উপাদান মজুদ থাকার পরও আমরা সেই অবস্থাকে সামাল দিতে পেরেছি, বিশেষ করে সেই তিন দিন, যখন দেশে কোনো সরকার ক্ষমতায় ছিল না, পুলিশ বাহিনী ছিল না, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল পুরো সময়। আমরা গোটা দেশ এক হয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়ে দেশ রক্ষায়। যদিও মন্দির পাহারা দেওয়ার কনসেপ্টের সঙ্গে আমি একমত নই, কারণ আমাদের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রে মন্দির পাহারা দেওয়ার কথা ভাবাই লাগবে না; তবু সেই সময়টায় পালা করে মন্দির পাহারা দিয়েছে জনতা। আইনশৃঙ্খলা নিজেরাই টিকিয়ে রেখেছে, পাহারা দিয়েছে রাতভর। রোড-ট্রাফিক সামলেছে ছাত্ররা। এলাকার বাসিন্দারা রাত জেগে ছিনতাই/ডাকাতি মোকাবিলা করেছে। সেই সময়ের অনেক কয়টা ছবি ভাইরাল হয়েছিল। এক লোক তার বিশাল বুলডগ কুকুর নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন রাতে। জেনারেশন জেডের ছেলেরা ড্রোন উড়িয়ে ডাকাত খুঁজছে। মোহাম্মদপুরে মহল্লাগুলোতে উৎসবের একটা আবহ চলে এসেছিল, রাতভর জেগে পাহারা দিচ্ছিল মহল্লাবাসী। সেই জেগে থাকা উপলক্ষে খিচুড়ি রান্না, পাড়ার সাংস্কৃতিক উৎসব সবই হয়েছে। এই সবকিছু আমাদের জন্য অভূতপূর্ব ছিল।
আমাদের এই সাংস্কৃতিক এবং কালচারাল বোধের সম্মিলন নিয়ে আলাপ করা দরকার বেশি করে। আমাদের ভেতরকার ঐক্য নিয়ে কথা বলা দরকার, সেটার লালন করা দরকার। কারণ এই ঐক্যই আমাদের দেশকে একটা অনিশ্চয়তার হাতে ফেলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেই গোটা সময়ে কেউ ধর্মের ধোঁয়া তুলে কারো উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেনি। নিজের ক্ষমতার দম্ভ দেখায়নি। হ্যাঁ, দেশের নানা জায়গায় নানা ঘটনা ঘটেছে, হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে, বিগত সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করা নেতাদের ওপরও হামলা হয়েছে। তবে দেশকে দুই ভাগ করে দেবে, হুমকির মুখে ফেলবে এমন কিছু সেই সময়টায় ঘটেনি।
দুই
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলার অবনতি, লোকজনের রাজনৈতিক এজেন্ডা ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতা দখলের পরই বরং প্রবল হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর ওপর সরকারের কতটা কর্তৃত্ব ছিল, সেটা বোঝা যায়নি গোটা সময়। নানা জায়গায় নানা মাত্রিক মব তৈরি হয়েছে, কেউ মাজার ভেঙেছে, কেউ বা সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ করেছে। আর ছিনতাই, ডাকাতি তো প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে। কিশোর গ্যাং রাস্তায় এসে কুপিয়ে গেছে মানুষকে। রাজনৈতিক মতবিরোধের জন্য দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে মাথায় ইট মেরে খুন করা হয়েছে। সরকার যদি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত, তাহলে এসব ঘটত বলে আমি মনে করি না। সরকার বরং মবকে নানাভাবে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। কোথাও বরং মবের নাম পাল্টে সেটাকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ মব তো কখনো একটা ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য উপকারি কিছু হতে পারে না।
ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিটাও প্রকট হয়েছে। ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে অধর্মকেও নানাভাবে উদযাপন করা হয়েছে। নানা জায়গায় মাজারে হামলা, মাজার ভেঙে দেওয়া, আবার সেই ভাঙচুরকে উদযাপনও করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী নিপীড়ক কর্মচারীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে ইসলামপন্থি লোকেরা।
সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি, শরিয়াপন্থি লোকেরা তাদের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। শরিয়াপন্থি রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এটা স্বৈরশাসনের দিকেই
নিয়ে যাবে এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে দেশের মধ্যেই এবং নানাভাবে ফ্যাসিজমের দিকে ধাবিত করবে। কারণ প্রথমত শরিয়া মানে তো ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক শাসন। দেশে কেবল ইসলাম ধর্মের মানুষ নেই, বরং নানা ধর্ম ও পরিচয়ের মানুষ আছে, যারা ইসলামকেন্দ্রিক শাসন বিশ্বাস করেন না এবং সেই শাসনে থাকবেন না। শরিয়া তখন তাকে দমিয়ে দেওয়াকে শরিয়তেরই দাবি মনে করব, ফলে ভিন্নমত দমন অনিবার্য হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, শরিয়ার ব্যাখ্যা, ধর্মের অথরিটি তো দেশে একটা দলের মানুষের হাতে না, বরং ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের মুসলমান অনেক কয়টি ভাগে বিভক্ত। শরিয়া যখন প্রয়োগ ঘটবে, কার ব্যাখ্যাকে ক্ষমতায়ন করা হবে, তা নিয়ে তখন মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ ঘটবে। যে বিবাদ ঘটেছে হজরত উমরের শাসন থেকেই। হজরত উমরসহ পরবর্তী তিন খলিফাই এই বিভক্তির জেরে মারা পড়েছেন। তারপর থেকে ইসলামি হিস্ট্রির পুরোটাই এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক ঝামেলার মধ্যে দিয়েই গেছে। ফলে শরিয়ার যেই ভাবনা আমাদের ইসলামপন্থিরা ভাবছেন, সেটা খানিকটা কাল্পনিকই মনে হয় আমার কাছে।
তিন
আমরা যে প্রবল বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা নিয়ে ইন্টেরিম সরকারের প্রধান হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের নিয়োগে খুশি হয়েছিলাম, তিনি সে জায়গাটি ধরে রাখতে পারেননি। বরং পুরো সময়ে স্বজনপ্রীতি, নিজের দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন অনেক কাজ করেছেন। তার নিয়োগগুলোও ছিল অদ্ভুত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাকে নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছুই জানেন না, বরং এনজিও বিষয়ে জানেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি অদ্ভুত কাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন বলে নানা জায়গা থেকে শোনা গেছে, করেছেন স্বজনপ্রীতি।
প্রফেসর ইউনূস নিজের মামলাগুলোকে খালাস করেছেন সরকারি প্রভাবে। অথচ এগুলো যদি তিনি লড়তেন, তাহলে দেশের মানুষের সম্মান পেতেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা পেয়েই কয়েকটি মামলা থেকে রেহাই নিয়েছেন। একই সঙ্গে নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়েছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের কর মওকুফ করেছেন। চিটাগংয়ের জন্য তার বরাদ্দের হাত খুলে গেছে। এসব বিষয় প্রমাণ দেয়, তার নেতৃত্বের প্রতি দেশের মানুষের ভরসার তিনি দাম দেননি।
লেখক : গবেষক