
শিশুরা একদিন বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে, সেটাই অভিভাবকদের আকাক্সক্ষা। এই বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় চারপাশের প্রতিটি মানুষের ভূমিকা থাকে। বাবা-মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তো থাকেই; পরিবারের বাকি সদস্যদের ভূমিকা থাকে বাবা-মাকে সহযোগিতায়। বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে শিক্ষকদের ভূমিকা থাকে বড় পরিসরে সমাজে কন্ট্রিবিউট করার আগে ক্ষুদ্র পরিসরে শিশুকে প্রস্তুত করার। রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকে অনেক ক্ষেত্রে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তা।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক স্ট্যাটাসে প্রথম বিশ্বের একটি দেশ নয়, কাজেই সমস্যাও প্রচুর! রাস্তার ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা পাই, দেখি ম্যানুয়াল ট্রাফিক সিগন্যাল ম্যানেজমেন্ট, দূষিত বাতাস, ময়লা ও আবর্জনা ফেলার দুর্বল ব্যবস্থাপনা, পাবলিক টয়লেটের অভাব, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মূল্য নিয়ে নিত্য বাহাস, শিশুদের রেজাল্টভিত্তিক লেখাপড়া, কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য, ফরমালিনযুক্ত খাবারসহ বহু বহু সমস্যা। বিশেষ করে শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি পত্রপত্রিকায় নানাভাবে আমাদের সামনে আসছে। ধর্ষণ, রাস্তাঘাটে এক্সিডেন্টসহ নানা নিরাপত্তা সমস্যার মুখোমুখি আমরা হচ্ছি।
বিশেষ করে কিছুদিন আগে মাইলস্টোন স্কুলে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা আমাদের পুরো দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে। আমরা নতুন করে স্কুলে ক্লাস করতে থাকা শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। অভিভাবকদের সন্তান হারানোর গল্প, বেদনায় মাখা মুখ, সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়ের স্মৃতিগুলো আমাদের বাকহারা করেছে!
যখন কোনো অঘটন ঘটে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকি; অনেক কিছু ভাবতে থাকি। যেহেতু এক একজন মানুষ নানা রকম ভাবনা, আবেগ ও চাপের মধ্য দিয়ে যায়, তাই পরিস্থিতি, আবেগ সামাল দেওয়ার প্রক্রিয়াও এক একজনের এক এক রকম। মোটা দাগে বললে, মানসিক স্বাস্থ্য এ সময় একটা নাজুক অবস্থায় থাকে। কাজেই যত্ন নেওয়ার আবশ্যিক প্রয়োজন আছে।
বেশ কিছু পরিস্থিতি নিয়ে আমরা ভাবতে পারি।
১. পরিবারে একাধিক শিশু ছিল, একজন শিশুর প্রয়াণ হয়েছে-এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে। এই পরিস্থিতি এমন যেখানে শিশুর খেলার সাথি হারিয়ে গেছে, সে একাকী হয়ে গেছে। বাড়ির বড়রা কাঁদছে, শোকে ডুবে আছে, নাওয়া-খাওয়ার হয়তো ঠিক নেই; তখনো তাদের অন্য শিশুর কথা ভাবতে হচ্ছে। এটা কঠিন। অন্য শিশুকে সময় দেওয়া, ব্যস্ত রাখা জরুরি। কিন্তু ওরা এ অবস্থায় কীভাবে পারেন?
সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাবনার বিষয় আছে। কারণ আমরা কি বড় মানুষেরা সব সময় জানি যে শিশু দুজন এঁকে অপরের সঙ্গে কীভাবে খেলত? কেমন ছিল তাদের খেলার ভুবন? কোন খেলনা নিয়ে কীভাবে খেলত? জানি না! ভেঙে যাওয়া আগের ভুবন নতুন করে সাজানো খুব সহজ নয়! ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুকে যেকোনো খেলায় মন ঘুরিয়ে দেওয়াও কঠিন! কারণ ভাষার অভাবে শিশুরা বলতে পারে না ঠিক, কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে।
এ সময় সবচেয়ে কঠিন হলো বড়দের নিজেদের শোক ভুলিয়ে বাড়ির অন্য শিশুর কথা ভাবা, তাকে সময় দেওয়া, তার মন ঘুরিয়ে দেওয়া। একজন প্রফেশনাল মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিলে খুব ভালো হয়। তবু বলব, বড়দের মনটা একটু শান্ত করে অন্য শিশুর কথা ভেবে যদি কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটানো যায়! বাড়িতে থাকা নানা স্মৃতি মানসিকভাবে ক্লান্ত করে। এ অবস্থায় প্রকৃতির মাঝে যদি কিছুটা সময় কাটানো যায় শিশুকে নিয়ে, তাহলে খুব ভালো হয়। প্রকৃতি নিজেই একটা চমৎকার ওষুধ, একই সঙ্গে দেহের ও মনের। এ নিয়ে অভিভাবকরা ভাবতে পারেন।
২. যেখানে বাবা-মায়ের সব সন্তানের প্রয়াণ হয়েছে-
এই পরিবারটিকে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা কি আদৌ জানা আছে? এদের পাশে দাঁড়িয়ে কোনো সান্ত্বনার বাণী না শুনিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাই সবচেয়ে বড় ওষুধ। কোনো কথা বা সান্ত্বনা এ মুহূর্তে কাজে লাগে না। মুসলমান পরিবারের ক্ষেত্রে শিশুদের জান্নাতে যাওয়ার কথা আমরা জানি। এও জানি যে তারাই পরকালে বাবা-মাকে বেহেশতে নেওয়ার শাফায়েত করবেন। কিন্তু বাস্তবে ঠিক সে সময় বেহেশত, জান্নাত এগুলোর ভাবনা কাজ করে না। এ ভাবনা বিবেচনায় আসে না। একটা কথাই কেবল মাথায় বারবার আসে; কেন আমিই? কেন আমার সঙ্গেই হতে হবে?
মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে কেবল কারণ খোঁজার ও বোঝার চেষ্টা করে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যে মানুষ নিজেকে একটা বুঝ দিয়ে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সান্ত্বনার তীরে ভিড়তে চায়। যেটা কঠিন, কারণ যা আমরা জানি না তার কারণ বের করা খুব কঠিন। আর সেটা কতখানি যৌক্তিক, সেই গ্যারান্টিই বা কে দিচ্ছে?
সব সন্তান হারানো অসম্ভব বেদনার। পরিবারের পাশাপাশি আমরা যারা তাদের চিনি না ব্যক্তিগতভাবে তারাও পাশে থাকতে পারি। একটি বড় কাজ হলো অঘটনের ভয়াবহ ছবিগুলো সামনে নিয়ে না আসা। সাংবাদিকরা একটু সংবেদনশীলভাবে খবর সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে পারেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় মাইক্রোফোনটি একটা নির্দিষ্ট দূরে রাখতে পারেন। খবর সংগ্রহ করাই সব নয়; শালীনতা বলেও একটি বিষয় আছে। যেখানে মানবিক আচরণই শালীন আচরণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ছাপ রেখে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টগুলো খুব মানবিকভাবে লেখা হতে পারে। টিকটক বা রিলস এগুলো অনেক সময় খুব অমানবিকভাবে আমরা তৈরি করি! দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যেভাবে ভিডিও তৈরি করা হয়, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই নিম্নমানের, অমানবিক এবং ভুল তথ্যসংবলিত। এটুকুর মাধ্যমেও কিন্তু আমরা অনেকখানি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি!
পাশাপাশি হাওয়া বদলের কথা আবারও বলব। সেটা প্রকৃতি হলেই খুব ভালো হয়। প্রকৃতি এবং একই সঙ্গে মন খুলে পুরো বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা করার বিকল্প অনেক কিছুই থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। তবে আশপাশের পরিবারের ভূমিকাও একেবারে কম নয়!
আসলে জীবনের বাস্তবতা এই-আমরা হারাব, প্রাপ্তি হবে, কাঁদব, হাসব। অঘটন আমরা কেউ চাই না, কিন্তু ঘটে গেলে কীই বা করতে পারি? মেনে নিলে একটা সময় সহজ হয়ে আসে সব। এটা কঠিন, তবু মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। জীবনের বাকি সময় তা না হলে কাটবে কীভাবে?
আমরা সাধারণ মানুষ কেউ অঘটন চাই না। রাষ্ট্র চাইলে যতভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, করা উচিত। রাষ্ট্রের নিজ দায়িত্বে গাফিলতি হবে না এবং একই সঙ্গে জনগণকেও সতর্ক করবে; তবেই না সম্মিলিতভাবে আমরা একটা কিছু অর্জন করতে পারব!
চলুন যে মানুষগুলো সন্তান হারিয়েছেন, সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই, মানুষের মতো আচরণ করি, মানবিকভাবে ভাবি, রাষ্ট্রকে সঠিক সমালোচনার মাধ্যমে গাইড করি, পরিবারের মধ্যে প্রতিটি সদস্যের মন ও মননের দিকে নজর দেই। সবাইকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। ঠিক এ মুহূর্তে আত্মীয় বা প্রতিবেশী হিসেবে অকারণ কৌতূহল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে মন্তব্য না করে বরং ভুক্তভোগী মা-বাবাকে, তাদের জীবিত অন্য সন্তানকে কিছু সময় দেই, খেলি এবং নতুন করে খেলার ভুবন তৈরিতে সাহায্য করি!
লেখক : শিক্ষা গবেষক ও লেখক