
দেশে চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু কিংবা অন্যান্য ক্ষতির ঘটনা নতুন কিছু নয়। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও আমাদের দেশে এর জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রচলন খুবই কম। চিকিৎসক যখন কোনো রোগীকে সেবা প্রদান করেন, তখন এক ধরনের অলিখিত চুক্তি তৈরি হয়, যদিও এটি লিখিত থাকে না। এখানে রোগী সেবা নিতে আসেন এবং চিকিৎসক সেবা প্রদান করেন, তা অর্থের বিনিময় হোক বা না হোক। এই চুক্তির মধ্যে যদি চিকিৎসক অবহেলা করেন এবং এর ফলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে আইনি প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয়।
চিকিৎসায় অবহেলা বলতে চিকিৎসক ও রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত অন্য ব্যক্তির অবহেলাকেই বোঝানো হয়। চিকিৎসায় অবহেলা অস্ত্রোপচার বা অপারেশন সংক্রান্ত নয়। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা, দুর্ব্যবহার করা, ভুল ওষুধ দেওয়া, মৃত রোগীকে আইসিইউতে রাখা, রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে অন্যত্র পাঠানো, ভুল রিপোর্ট দেওয়া, হাসপাতালের শয্যা না থাকার অজুহাতে চিকিৎসা না দেওয়া ইত্যাদি। চিকিৎসকরা ফি নির্ধারণসহ আরো অনেক বিষয়ে ‘দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিস্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ এই নির্দেশনা প্রাপ্ত।
বিশ্বের অনেক দেশে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে টর্ট আইন অনুসারে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে টর্ট আইনের জন্য আদালত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে চিকিৎসকের শাস্তি চেয়ে বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে হয়। আমাদের দেশে চিকিৎসায় অবহেলার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। ফলে কোন কাজগুলো চিকিৎসায় অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে তা নির্ধারণে স্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। ফলে অন্য আইনের বিধান ও আদালতের নজিরের ওপর নির্ভর করতে হয়।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪এ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনিত কোনো কাজের মাধ্যমে কারো মৃত্যু ঘটালে এবং এটি শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হলে, সেই ব্যক্তি অবহেলাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। এই ধারা অনুসারে, চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে পুলিশ অভিযুক্ত চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করতে পারেন, তবে সর্বোচ্চ আদালত এই ধরনের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করেছে।
চিকিৎসায় অবহেলার কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ভুক্তভোগী মামলা করতে পারেন। অধস্তন আদালতের পাশাপাশি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টে রিট করা যাবে। কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নজিরও রয়েছে, তবে এর পরিমাণ নির্ধারণ কঠিন। চিকিৎসা অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আইনের আওতায় শাস্তির মুখোমুখি হতে বাধ্য। এটি রোগীদের নিরাপত্তা এবং অধিকার সুরক্ষিত করতে সহায়ক। সঠিক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই ধরনের পরিস্থিতি কমিয়ে আনা সম্ভব, যাতে রোগীরা তাদের চিকিৎসার সময় নিরাপদ ও সুরক্ষিত বোধ করেন।
তবে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলার সুস্পষ্ট অভিযোগ না থাকলে অযথা মামলা করে হয়রানি করা থেকে সবার সতর্ক থাকা উচিত।