এনসিপি কেন সংস্কারের ভার সংসদের হাতে ছেড়ে দিতে চায় না

আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪৬

সংস্কার কার্যক্রমের ভার নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দেবে না জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জুলাই সনদের ভিত্তিতেই পরবর্তী নির্বাচন হতে হবে। আমরা নির্বাচিত সংসদের হাতে এই সংস্কার কার্যক্রম ছেড়ে দেব না, বরং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই আগামী সংসদ গঠিত হবে, গণপরিষদ গঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে।’ (সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, ২ আগস্ট ২০২৫)।
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার আমরা এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছি। এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচারব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।’
প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও বলেছিলেন, যেসব সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো তারাই শেষ করে যাবেন। জুলাই অভ্যুত্থানের বিচার শুরু হয়েছে। কিছু আইনি সংস্কারও হয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ ও বাকি সংস্কারগুলো যদি এই সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে বেশ কিছু প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের মতো একটি বিরাট কাজ করবে, এটি গণতান্ত্রিক কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
যেমন অন্তর্বর্তী সরকারকে যদি সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে তাদের পক্ষে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি তো দূরে থাক, জুনেও নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। তার মানে নাহিদ ইসলাম বা তার দল কি চান যে এই সরকার আরো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকুক? তার চেয়ে বড় কথা, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস নিজেও কি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চান?
রাষ্ট্রের সবকিছু তার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলে এবং অন্তর্বর্তীকালের শাসন নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের মনে সন্তুষ্টি বিরাজ করলে দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নটি জোরালো হতো না। কিন্তু গত এক বছর সরকার কি জনমনে স্বস্তি দিতে পেরেছে? মানুষ কি মনে করে যে এই সরকারের আরো দুই বা তিন বছর ক্ষমতায় থেকে কাক্সিক্ষত সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে যাওয়া উচিত?
জনগণ চায় কি চায় না বা এই সরকারের ওপর তাদের আস্থা আছে কি নেই, সেটি জানার জন্য ‘গণভোট’ একটি উপায় হতে পারত, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যে তিনটি গণভোট হয়েছে তার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সব গণভোটই ছিল সাজানো এবং তার ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। প্রথমত, মানুষ এ ধরনের ভোটে অংশ নিতে আগ্রহ বোধ করে না। দ্বিতীয়ত, ওই তিনটি গণভোটই হয়েছে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং ইউনূস সরকারের ওপর মানুষের আস্থা আছে কি নেই; সংস্কার ও সনদ বাস্তবায়নে তারা এই সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় দেখতে চায় কি না, সেটি জানার জন্য যদি একটি গণভোটেরও আয়োজন করা হয়, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সেই ভোটের ফলাফল কি হবে, তা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। আবার এটিও ঠিক যে, সরকারপ্রধান যত যোগ্য ও ভালো মানুষই হোন না কেন, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার তার নেই। আর জনগণের ম্যান্ডেট আছে কি নেই, সেটি জানার একমাত্র উপায় হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন।
বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের ম্যান্ডেট আছে, কেননা এই সরকারটি গঠিত হয়েছে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এবং গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, সে হিসেবে পরোক্ষভাবে হলেও এই সরকারের ওপর জনগণের ম্যান্ডেট আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেসব দলের সমর্থনে এই সরকারটি গঠিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটিই চায় দ্রুত নির্বাচন। অর্থাৎ তারাও চাচ্ছে না অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকুক। যদি এই এক বছরে সরকার জনগণের স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারত; রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বদলে সত্যিকারের ইনক্লুসিভ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করত; যদি জনগণের মনে এই বিশ্বাস জন্ম না নিত যে তারা উগ্র ডানপন্থি ও কট্টরপন্থিদের কবজায় চলে গেছে; যদি নির্দিষ্ট দু-একটি দল ও সংগঠনের প্রতি সরকারের পক্ষপাত ও সমর্থন স্পষ্ট না হতো, তাহলে সংস্কার ও জুলাই সনদ এই সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করত না। কিন্তু সরকার এই কাজগুলো করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেদের দুর্বলতা ও পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ দিয়েছে। সুতরাং এ রকম একটি দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট সরকারের ওপর সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ভার ছেড়ে দেওয়াটা যেমন নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি সংস্কার ও সনদ বাস্তবায়নের মতো সক্ষমতাও তাদের নেই।
তাহলে সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে নির্বাচন এবং প্রধান উপদেষ্টার ভাষায় সেটি হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন। ভালো নির্বাচন মানে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে, যদি সেখানে সরকার কারচুপি করে বা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং এই সরকার যে ভালো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেটি নিশ্চিত করার মতো দক্ষতা, সক্ষমতা ও আন্তরিকতা তাদের আছে কি না, সেই প্রশ্নও অনেকে তুলছেন।
তবে সেই সংশয়ের মধ্যেও নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে বলে যে ঘোষণা এসেছে, সেটি নিশ্চিত করা তথা নির্বাচনটি সময়মতো আয়োজনে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করাই এখন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দায়িত্ব। যদি সত্যিই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়
এবং এককভাবে কিংবা একটি কোয়ালিশন সরকারও গঠিত হয়, তার পরও অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে সেটি উত্তম। নির্বাচিত সরকার মানে তাদের ওপর জনগণের ম্যান্ডেট থাকবে। সেই ম্যান্ডেট যাদের থাকবে তারাই সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে, এটিই যৌক্তিক। এ জন্য নির্বাচনের আগেই দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা ও ঐক্য হতে হবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি যেকোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সংসদে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নাহিদ যদি মনে করেন যে নির্বাচিত সরকার সংস্কার ও সনদ বাস্তবায়ন করবে না, তাতে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসবে। ১. তিনি কি জানেন কারা সরকার গঠন করবে? ২. যারা সরকার গঠন করবে বলে তিনি ধারণা করছেন, তাদের ওপর এনসিপি ভরসা করতে পারছে না বা বিশ্বাস করছে না? ৩. নির্বাচিত সংসদকে অবিশ্বাস করার মানে হলো জনগণকে অবিশ্বাস করা। জনগণের ওপর কি এনসিপির আস্থা ও ভরসা নেই? ৪. এনসিপি গঠিত হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের নেতৃত্বে, যারা বিশ্বাস করেন দেশের মানুষ তাদের সঙ্গে আছে।
তাদের দলের একজন শীর্ষ নেতা দাবি করেছেন, নির্বাচনে তারা তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হবেন। যদি তাই হয়, তাহলে সরকার গঠন করে তারাই তো সংস্কার ও সনদ বাস্তবায়ন করতে পারেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে চান কেন? নাকি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো আত্মবিশ্বাস এনসিপির নেই?