সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি

জয়নাল আবদীন
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১৭:৪৬

বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশের আইনসভার সদস্য নির্বাচনের যে দুটি পরিচিত পদ্ধতি তার একটি হচ্ছে আসনভিত্তিক কাস্টিং ভোটের সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জয়-পরাজয় নির্ধারণ। অন্য পদ্ধতিটি হচ্ছে গোটা দেশের কাস্টিং মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে সংসদের নির্ধারিত আসনগুলো বণ্টন। বিশ্বের অনেক দেশ আসনভিত্তিক জয়-পরাজয় পদ্ধতি অনুশীলন করে আবার বহু দেশ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির চর্চা করে। ইদানীং সারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় সংসদ আসন বণ্টন বিষয়ে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব নিয়ে তোলপাড় চলছে। যদিও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই পদ্ধতির প্রস্তাবক। কিন্তু এই পদ্ধতির অনুশীলনের দাবি নিয়ে রাষ্ট্র সরকার আন্দোলন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে দাবি জানিয়ে আসছে।
জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রস্তাবে কোন ধরনের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করেছে, সেটা পরিষ্কার করেনি। বিশ্বে তিন ধরনের সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা দেখা যায়। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে প্রতিটি আসনে নিজ নিজ দলের প্রার্থী ঘোষণা করবে, প্রতিটি দল ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যানুপাতে যে কয়টি আসন লাভ করবে, দলীয় প্রার্থীদের ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্রমানুসারে দলীয় আসন বণ্টন হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে দল কোনো প্রার্থী ঘোষণা করবে না। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে যতগুলো আসনপ্রাপ্ত হবে, সেই আসনগুলো দল তার ইচ্ছামতো দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বণ্টন করবে। তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে কতেক আসনে আসনভিত্তিক বিজয় পদ্ধতি এবং কতেক আসনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আমরা কোন পদ্ধতি গ্রহণ করব, প্রস্তাবে সেটি উল্লেখ করা হয়নি।
প্রশ্ন হলো, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Represention আমাদের দীর্ঘ সময়ের অভ্যস্ত পদ্ধতির বিপরীতে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে। এই পদ্ধতির ভালোমন্দ, আসনওয়ারী পদ্ধতির দোষ-গুণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার দাবি যেমন রাখে, তেমনি বিদ্যমান পদ্ধতির দোষত্রুটি বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বিশ্বের প্রায় ৯১টি দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সংসদীয় আসন বণ্টন হয়। আসনভিত্তিক জয়-পরাজয় সিস্টেমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব অনুপস্থিত থাকে। এই পদ্ধতিতে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে প্রথম সারির দলগুলোই শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়। ছোট দলগুলো ধর্মভিত্তিক, আদিবাসী জনগণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণের আক্ষরিক অর্থে সংসদে কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। দেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে যে বাস্তব চিত্র আমরা দেখতে পাই, সেটি হচ্ছে বড় বিজয়ী দলের একক আধিপত্য যেমন সংসদে থাকে, তেমনি সমগ্র দেশ তাদেরই ক্ষমতার দাপটে প্রকম্পিত হয়। পরবর্তী অবস্থানের বিজয়ী দল ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ এবং এক ধরনের আধিপত্য জাহিরের উল্লেখযোগ্য সুযোগ পায়। বাকি দলের সংখ্যানুপাতিক ভোট যদি বিজয়ী দলের প্রাপ্ত ভোট থেকে বহুগুণ বেশিও হয়। রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংসদে তাদের কোনো অংশীদারি বা প্রতিনিধিত্বের অধিকার কার্যত হয় না। নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন হিসাব- নিকাশের কারণে দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ, অতিষ্ঠ। বড় দলগুলোর দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা এবং তাদের কায়েমি স্বার্থের পাহারাদার হিসেবে আসনভিত্তিক Winning System স্বার্থ ভোগীদের কাছে যতটা জনপ্রিয়; সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় ততটা ফলপ্রসূ নয়। বড় দলগুলো দেশে এক ধরনের কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণি সৃষ্টি করে রেখেছে। বড় দলগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট, অঢেল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে রেহাই পেতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বহুলাংশে স্বস্তিদায়ক। আসনভিত্তিক পদ্ধতির চেয়ে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি তুলনামুলক উৎকৃষ্ট হলেও এই পদ্ধতিরও বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায়। প্রথমত, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেসব দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বণ্টন হলে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের জয়-পরাজয় কীভাবে নির্ধারণ করা হবে? ছোট ছোট নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে বড় দলগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে যেভাবে নিজেদের কাছে টানত, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দলগুলো মানুষ ভাড়া করে বড় দলের আহ্বানে সাড়া দেবে না। চার-পাঁচটি দলের বাইরে দেশের অবশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূলে কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। তারা বড় দলগুলোর তাঁবেদার হিসেবে মাঠে-ময়দানে থেকে নির্বাচনের সময় দু-চারটি আসনে মনোয়ন পায়। নিবন্ধিত ৫৫টি দলের বেশির ভাগই এক নেতার দল। এসব দলের কোনো সংগঠন নেই। রাষ্ট্রে যেমন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা নেই। পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র আর মাফিয়াতন্ত্র ছোট-বড় সব দলকে কবজা করে রেখেছে। একই ছিলছিলার মানুষেরাই নেতার পর নেতা হচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় নির্বাচনকেই শুধু গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বন্দি করে রেখেছেন, জনসমর্থন নেই। পিআর পদ্ধতি চালু হলে ছোট দলগুলো গ্রামে-গঞ্জে তাদের সমর্থন ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির আপ্রাণ চেষ্টা করবে। যেহেতু ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বণ্টন হবে, সেহেতু জনসমর্থন বাড়তে পারলে সংসদে আসন পাওয়াটা এক প্রকার নিশ্চিত। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গৃহীত হলে ছোট-বড় সব দলের কর্মকাণ্ড প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পিআর পদ্ধতি সোনায় সোহাগা হবে, বড় দলগুলো সংখ্যালঘু মানুষের আর নির্বাচনী তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না। এই পদ্ধতির সুবাদে দেশে আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত শতাধিক রাজনৈতিক দলের পাঁচ-দশটি দল সরকারি দল এবং বিরোধী দল হিসেবে সংসদ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। দেশের বাদবাকি রাজনৈতিক দলগুলো দেশের জন্য কোনো অবদান রাখার সুযোগ পায় না। অর্থাৎ দেশের বৃহত্তর এক জনগোষ্ঠীর দেশ পরিচালনার কোনো ধরনের অংশীদারি বা প্রতিনিধিত্ব থাকে না। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা উত্তরণ হলে সব দলই কোনো না কোনোভাবে দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাবে। অন্তত সংসদে গিয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার থাকবে। যার কারণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করার সমূহ-সম্ভাবনা রয়েছে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নেতিবাচক দিক হলো সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে। কোনো একক দল সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, অন্য দলের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। তখন সরকারের স্থিতিশীলতার বিষয় সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি আসনভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে উত্তম। সব মানুষের প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা থাকে। সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দল নিজেদের ইচ্ছামতো সংসদ ও রাষ্ট্র চালাতে পারে না। এতে এক ব্যক্তির ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরা যায়। নিজেদের মর্জিমাফিক আইন প্রণয়ন করাতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় যে চরম ঘাটতি রয়েছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চায় অধিকতর উৎসাহি হতে বাধ্য হবে। দলগুলোর মনোনয়ন বেচাকেনার যে প্রবণতা আমরা দেখতে পাই, তা বহুলাংশে দূর হবে। কারণ দলের সমর্থক গোষ্ঠী দলের বাইরের কোনো আগন্তুক প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বিপর্যয় ঠেকাতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অনুশীলনে যত্নবান হবে। সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্র পরিচালনায় সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের দিক থেকে আসনভিত্তিক বিজয় পদ্ধতি থেকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অধিক ফলপ্রসূ।