
বেশ কয়েক বছর ধরেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাত্রার প্রবণতা বাড়ছে। কেন বাড়ছে এটা আলোচনার বিষয়। এর আগে দেখতাম, মধ্যবিত্ত সমাজের একটি অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েদের পড়াত। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ নবম শ্রেণিতে উঠেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যেত এবং পড়াশোনা করে আবার আসবে বললেও আর ফিরত না। একসময় পুরো পরিবার চলে যেত। এখন এই ঘটনাটি আর ভারত, মধ্যবিত্ত বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন মেধাবী ছেলেমেয়েরা এসএসসি পাস করতে করতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করে। তারপর একদিন চলে যায়। এ ব্যাপারে একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে প্রথমেই যে বিষয়টি এসেছে সেটা হলো মানসম্মত উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতার মতো বিষয়গুলো তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে।
অনেকে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিলেন। কথা উঠেছিল ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেইন’ শুরু হবে। কিন্তু তেমনটি বাস্তবে দেখা যায়নি। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়েও শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা, সরকারি নিয়োগে ধীরগতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকায় তরুণ শিক্ষার্থীদের হতাশা দূর হয়নি। ফলে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত আছে এবং বেশির ভাগই যাচ্ছে স্থায়ী হওয়ার উদ্দেশে।
জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন ইনাম হোসেন। তার কথামতো, ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার যে মান এবং শিক্ষা দেওয়ার যে পদ্ধতি, সেটা আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করাও কষ্টকর। তা ছাড়া পড়ার সময়েই চাকরি করা যায়। এটা আমাদের দেশে তো সোনার হরিণ। বিদেশে পড়লে যে সুবিধাটা প্রথমেই মেলে তা হলো পড়ার সঙ্গে চাকরি। যে কারণে মা-বাবাকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলতে হয় না। শিক্ষার মানের দিক থেকেও এসব দেশ অনন্য। সুতরাং সুযোগ পেয়ে দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে কেন পড়বে?
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই প্রবণতার জন্য দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। ‘যারা মধ্যবিত্ত তারাও উচ্চবিত্তদের দেখে এই রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করল। যেহেতু বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা বাংলা মাধ্যমে পড়বে না। ফলে মূলধারাকে উন্নত করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ দেখা যাবে না। যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের ছেলেমেয়েরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। ধনীদের সন্তানরা প্রাইভেটে যাবে বা বাইরে যাবে। এখন যারা প্রাইভেটে ভালো পড়ালেখা হচ্ছে না বলে মনে করছেন তারাই সন্তানদের বিদেশে পাঠাচ্ছেন। এটা রাজনৈতিক সমস্যা। রাষ্ট্র যেভাবে সম্পদ পাচারে বাধা দিচ্ছে না, একইভাবে তারা ছেলেমেয়েদের বিদেশ পাঠাতে বাধা দিচ্ছে না।’
চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, গত চার দশকে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তাদের শিল্পক্ষেত্রে। বাংলাদেশে সেটা ঘটেনি। তরুণদের উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত করতে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মালিহা। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে এসেছেন বেড়াতে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেনমার্কের শিক্ষার মান নিয়ে কিছু না-ই বলি। আর বাংলাদেশের শিক্ষা পরিকল্পিত নয়। যে কারণে শিক্ষা শেষে কাজ পেতে জীবন বেরিয়ে যায়। স্নাতক পাস করা একজন শিক্ষার্থী ২০ হাজার টাকার বেশি বেতনের চাকরি পায় না। সেদিক থেকে হিসাব করলে নেদারল্যান্ডসে যে টাকা পাওয়া যাবে তা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তিন লাখ। মানে পড়াশোনা করে মা-বাবাকে টাকা পাঠানো যাবে। তা ছাড়া দেশের অস্থিতিশীলতার কথা ভাবলে কোনো মতেই আসতে ইচ্ছা করে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশিদের বিদেশে শিক্ষার ব্যয় ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি মুদ্রায় ব্যয়কৃত এ অর্থের পরিমাণ আট হাজার ৭৯ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। কেবল ব্যয় নয়, বরং সংখ্যার দিক থেকেও এখন সর্বোচ্চসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণে এমনটাই দেখা যায়।
শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমনের প্রবণতার কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। তিনি বলেন, ‘বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যায় ভারত শীর্ষে রয়েছে। তাদের শিক্ষার্থীরাই বর্তমানে অ্যামাজন, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন এবং এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরাও অত্যন্ত মেধাবী, তারা এসব প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে যেতে পারলে তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। তবে আমাদের শিক্ষার্থীদের দেশে রাখার বিষয়েও সচেষ্ট হতে হবে। এ কারণে মানসম্মত শিক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’ ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১০ বছরের ব্যবধানে বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের মতে, অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষাকে বিদেশ গমনের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং তাদের বেশির ভাগ আর দেশে ফিরছেন না। বিদেশগামী শিক্ষার্থী বৃদ্ধির বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী কোথায় পড়বে, এটি তার ব্যক্তিগত পছন্দ ও স্বাধীনতা। কোনো শিক্ষার্থীর যদি বিদেশে উচ্চশিক্ষার আগ্রহ থাকে এবং অভিভাবকও যদি তাকে বিদেশে পড়াতে চান তাহলে সেটি তারা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া উচিত নয়। এই প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে আমাদের দেশীয় শিক্ষার মানের উন্নতি ঘটিয়ে। সেই প্রয়াসটাই আমাদের করতে হবে, এটিই মূল বিষয়। কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়তো হয়েছে; কিন্তু শিক্ষার মান, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গুণগত দক্ষতায় ততটা উন্নতি ঘটেনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংকট রয়েছে।’
কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, দেশের শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, শিক্ষার পরিবেশ এমন নয় যে এখানে সন্তানকে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। বিশেষত বিগত সরকারের আমলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতির প্রভাব, গেস্টরুম কালচারসহ নির্যাতন-হয়রানির মতো ঘটনা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের শঙ্কিত করেছে। বিদেশে পাড়ি জমানোর এটাও একটি কারণ।
একটা ঘটনা মনে আছে, বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যার পরে আমার পাশের বাসার একটি ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও তার মা-বাবা তাকে সেখানে ভর্তি করেনি। একদিকে অর্থনীতি, শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ ও চাকরির অনিশ্চয়তা
মা-বাবার শঙ্কা-সব ক্ষেত্রে বিদেশে চলে যাওয়ার বিষয়টি ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রকে এটি নিশ্চিত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ পায় এবং শিক্ষা শেষে কাজ পায়। নতুবা দেশের মেধাবীরা বাইরের দেশে যেতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার চিত্রই বদলে যাবে। যেটা বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।