Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

আগস্টের গর্জন এবং কিছু স্বপ্ন

Icon

রাজেকুজ্জামান রতন

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৭:৩২

আগস্টের গর্জন এবং কিছু স্বপ্ন

৫ আগস্ট ২০২৪। সাগরের ঢেউ আর গর্জনের মতো জনতার ঢল আর গর্জন শুনেছিল বাংলাদেশ। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ক্ষোভ ছিল আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আর স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। 

বাংলাদেশের লড়াকু জনগণ যেকোনো অন্যায়, জবরদস্তি, দুঃশাসন মেনে নেয় না, কোনো স্বৈরাচারকেই ক্ষমতায় থাকতে দেয় না, বুকের রক্তে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, জীবন দিয়ে জীবনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে তা আবার প্রমাণ করেছিল ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানে। ১৫ বছরের স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচার বিরোধী সংগ্রাম যেন কেন্দ্রীভূত হয়েছিল জুলাই মাসে। পুলিশ, আর্মি, গোয়েন্দা সংস্থা আর দলীয় অস্ত্রধারীদের দিয়ে দমন করা যায়নি প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে। পুলিশ বলেছে, একটা গুলি করি একটাই মরে, কিন্তু কেউ সরে না। এত সাহস দেশের মানুষ দেখে নাই বহুদিন। কারফিউ দিয়ে, হেলিকপ্টার উড়িয়ে,  জীবন দিয়েছে হাজারের বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে ছিল ছাত্র, শ্রমিক, নারী, শিশু, পথচারী আর আহত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। যাদের অনেকেই কোনো দিন চোখে দেখবে না, নিজের পায়ে হাঁটবে না, কারো ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে পেটের ভেতরের অংশ, স্বাভাবিকভাবে মলমূত্র ত্যাগ করতে পারবে না অনেকেই। মৃত ব্যক্তিরা হারিয়ে গেছে জীবন থেকে আর আহতদের হারিয়েছে জীবনের ছন্দ।  

কিন্তু মৃত্যু যে জীবনের শেষ নয়, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে এই দেশে। যেকোনো গণ-আন্দোলনই রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করে। জনগণ দাবি নিয়ে আন্দোলন করে, আবার আন্দোলনের পথে সেই দাবিগুলো নতুন নতুন মাত্রা পায়। সব আন্দোলনেই কোনো কোনো মৃত্যু আন্দোলনকে গতি দেয়। যেমন-৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে আসাদ এবং মতিউর প্রেরণা ও সাহসের নাম। ৯০-এর অভ্যুত্থানে নুর হোসেন, জিহাদ ও ডা. মিলন স্বৈরাচারের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছেন। গত ১৫ বছর আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ জীবন দিয়েছে। কিন্তু ১৬ জুলাই আবু সাঈদের জীবনদান অসংখ্য জীবনকে জাগিয়ে তুলেছিল, ভয়ের শাসনকে উচ্ছেদের শক্তি দিয়েছিল, শাসকদের মনে ভয়ের কাঁপন জাগিয়ে তুলেছিল।  

এই ভূখণ্ডের প্রতিটি লড়াই ছিল মানুষের অধিকার ও মর্যাদার জন্য। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল স্বাধীনতার জন্য, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচারের জন্য। কিন্তু ব্রিটিশ গেছে স্বাধীনতা আসেনি, জনগণকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা হয়েছে, ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা ও শিক্ষার অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। বাইরের এই আক্রমণের অন্তরালে শক্তিশালী হয়েছে শোষণ। ফলে শোষণ মুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তান ছিল ২২ পরিবারের শোষণ, সামরিক শাসন, ধর্মীয় নিপীড়ন আর সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা রাষ্ট্র। এই শোষণের তীব্র রূপ প্রত্যক্ষ করেছে বাংলার মানুষ। ফলে ৬ দফা এবং ১১ দফা জনগণের আন্দোলনের দাবিনামায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০ সালের নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।  

স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে দেশের জিডিপি বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, বাজেট বড় হয়ে ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে সাত লাখ ৯০ টাকায় উন্নীত হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১১০ ডলার থেকে ২৮৪০ ডলারে। কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দেড় লাখ হয়েছে। কিন্তু কমেছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের মর্যাদা। শিক্ষার খরচ, চিকিৎসার খরচ, দ্রব্যমূল্য সবই বাড়ছে, সবচেয়ে বেড়েছে বৈষম্য।  যেমন আয়বৈষম্য তেমনি অধিকার, সুযোগ, ধর্মীয়, জাতিগত বৈষম্য সব ক্ষেত্রেই। পুঁজিবাদী সমাজে সবই পণ্য। এখানে টাকা যার জীবনের সব অধিকার তার। স্বাধীনতার পর থেকেই ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার তো ছিলই, গত ১৫ বছরে তা সীমাহীন রূপ নিয়েছিল। ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে একদলীয় নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচন, ২০২৪ সালে আমি-ডামির নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে ন্যক্কারজনকভাবে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন অপকৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে কোনো দিনই হারবে না, ক্ষমতা ছাড়বে না। শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই নয়, বিরোধী দল ও মতের ওপর চূড়ান্ত নিপীড়ন, দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া, বিদেশিদের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তি আর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দেশের সম্পদ ও সম্মান দুটিই ধ্বংস করছিল। এসবের বিরুদ্ধে মানুষের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে লাখ লাখ ছাত্র, শ্রমিক ও নারীকে রাজপথে নামিয়ে এনেছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার এই বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার। সফল হয়েছিল অভ্যুত্থান।    

বাইরে থেকে দেখলে এই অভ্যুত্থান আকস্মিক রাজনৈতিক ঘটনা। কিন্তু যেকোনো বড় আন্দোলন অনেক আন্দোলনের যোগফল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষাট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছিষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ আকাক্সক্ষা মানুষকে বারবার আন্দোলনের পথে নামিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো, জনগণ জীবন ও রক্তের বিনিময়ে  স্বৈরাচারকে পরাজিত করে আর পরবর্তী সময়ে শাসকরা তাদের পথই অনুসরণ করে। এক দখলবাজের পরিবর্তে আর এক দখলবাজ, এক দুর্নীতিবাজের পরিবর্তে আর একজন ক্ষমতায় আসিন হয়। তাই অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি থেকেই যায়।  

অতীতের এই বেদনাময় অভিজ্ঞতা থেকেই প্রত্যাশা ছিল অভ্যুত্থানের পর পুরোনো পথে যেন ফিরে না যায় দেশ। কিন্তু সংস্কার কথাটা যত উচ্চারিত হচ্ছে ততটা সংস্কার কি রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে? 

অভ্যুত্থানের এক বছর যেতে না যেতেই আকাক্সক্ষা ও চেতনাকে পদদলিত করা শুরু হয়েছে। সারা দেশে জোরপূর্বক চাঁদাবাজি, বিশৃঙ্খলা ও হত্যা, নারীর সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ, ধর্ষণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা দখল, দুর্নীতির নানা খবরে দেশের মানুষ বেদনাহত ও ক্ষুব্ধ।  

একটা ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের পর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ঘটবে-এটাই তো স্বাভাবিক। অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা এবং দায়হীন ক্ষমতা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সে কারণেই ক্ষমতা এবং দুর্নীতির মেলবন্ধনের অবসান ও বিকল্প দৃষ্টান্ত দেখতে চায় জনগণ। কিন্তু যেভাবে টাকা ও পেশিশক্তির সন্নিবেশ ঘটানো আর প্রয়োগ শুরু হয়েছে তা উদ্বেগজনক। শ্রমিক কৃষকের বুকের কান্না যেন ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা প্রত্যাশীদের স্পর্শ করছে না। যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে তা তো অতীতের ধারাবাহিকতা মাত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, ব্যাংকে কি গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে বা তার চর্চা হচ্ছে? যেভাবে গায়ের জোরের চর্চা হচ্ছে তাতে পুরোনো আমলের চেয়ে কি পার্থক্য ঘটল? এই প্রশ্ন কি অমূলক হবে? বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের লড়াই শত সহস্র মানুষকে পথে নামিয়েছিল। মানুষ ভুলতে চেয়েছিল নারী-পুরুষ, ধর্মীয় পার্থক্য, আদিবাসীর অবহেলা। প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল মানবিক মর্যাদা, দূর করতে চেয়েছিল বৈষম্যের বেদনা। কিন্তু সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন ও উন্মাদনা, নারীর লাঞ্ছনা, আদিবাসীর ভীতি, নির্বাচনবিহীন ও দায়হীন রাষ্ট্র পরিচালনা, নানা ধরনের চুক্তি, যা জনগণ জানে না-এসব কি জুলাইকে ভুলিয়ে দিচ্ছে না?  জুলাই কি শুধু দিবস উদযাপনে পর্যবসিত হবে? ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে জনগণের প্রত্যাশাকে যেন পদদলিত করা না হয়, স্বপ্নগুলো যেন অধরা না থাকে, সেটাই মানুষের আশা। প্রতিটি আন্দোলনে জনগণ যুক্ত হয় মুক্তির আশায়, কিন্তু পরিণতিতে দীর্ঘশ্বাস। এটাই কি চলতে থাকবে? 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫