Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

কবি থেকে প্রকাশক নজরুল-এক সংগ্রাম

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৬

কবি থেকে প্রকাশক নজরুল-এক সংগ্রাম

দ্রোহ আর সংগ্রাম যেন নজরুলের অপর নাম। কবিতা থেকে প্রকাশনা সব ক্ষেত্রে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন তিনি। উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার তীব্র আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত এক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বরাবরই তাকে বিদ্রোহী করে তুলছে। বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে যোগদান করার যে ডাক নজরুল ইসলামের কানে পৌঁছেছিল সেটা তার কাছে নিছক একটা যুদ্ধ ছিল না, তার কাছে ওটা ছিল দেশপ্রেমের আহ্বান। নইলে ক্লাসের প্রথম ছাত্র, সবাই যখন ভাবছিল পরীক্ষা দিলে সে স্কলারশিপ পাবে, সে কী কারণে সব ছেড়ে চলে গেল! তরুণ সৈনিকরা দেখা যায় প্রায়ই উদ্দাম স্বভাব নিয়ে ফিরে আসেন। আর সেখান থেকে নজরুল ফিরে এলেন দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে। সাধারণ সৈনিকের মতো শুধু যুদ্ধ তার উদ্দেশ্য ছিল না কখনো। তাই তো রাজনীতির সব রকম অনুষঙ্গ তাকে আকৃষ্ট করেছে। 

পল্টন থেকে ফিরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী নজরুল ইসলাম যখন থাকতে এলেন, তখন সেই সময়ে সেখান থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছিল ‘মোসলেম ভারত’ নামে এক সাহিত্য পত্রিকা। আফজালুল হক এক প্রকার চুক্তি করলেন যে, নজরুল নিয়মিত মোসলেম ভারত পত্রিকায় লিখবেন। পরবর্তীকালে নজরুল ইসলামের লেখা ছাপানোর জন্য ‘মোসলেম ভারত’ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল না কি এই পত্রিকাটির জন্যই নজরুল রাতারাতি খ্যাতি লাভ করেছিলেন-এ নিয়ে মতভিন্নতা আছে। তবে এর কিছুদিন পরই কমরেড মুজাফ্ফর এবং কাজী নজরুল ইসলাম একটি নতুন বাংলা পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করতে লাগলেন এবং এ কাজে তাদের সঙ্গে সংবাদপত্রে কাজ করে এমন কয়েকজন পরামর্শকও ছিলেন। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করার জন্য টাকা দরকার। সেই ফান্ড কিভাবে জোগাড় হবে তারা সেই চিন্তায় ছিলেন। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে জনগণ যেমন বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল, অন্যদিকে কিছু ভারতীয় মুনাফাকারী নতুন জয়েন্ট স্টক কোম্পানিও রেজিস্ট্রি করেছিলেন। তারা (নজরুল-মুজাফফর) ভাবলেন, টাকা সংগ্রহের জন্য ওই রকম কিছু করা যায় কি না। পরামর্শের জন্য তারা তখন শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের কাছে গেলেন। তার কাছে প্রস্তাব করলে তিনি বললেন, পত্রিকা চালানোর সাহস থাকলে তিনি টাকা দিতে রাজি। সাহসের অভাব নজরুলের ছিল না বলাই বাহুল্য। সিদ্ধান্ত হলো, ২০ ইঞ্চি বাই ২৬ ইঞ্চি সাইজের একটি সান্ধ্য কাগজ তারা করবেন। তবে ফজলুল হক চাচ্ছিলেন, পত্রিকার একটা মুসলমানি নাম হোক। তার যুক্তি ছিল, তাদের কাগজ হিন্দুরা কিনবে না, আর অন্যদিকে মুসলমানরা বুঝতে পারবে না, এটা তাদের কাগজ। কিন্তু দুজনের কেউই মুসলমানি নামে রাজি নন। ফলে পত্রিকাটির নাম রাখা হয় ‘নবযুগ’। নবযুগ পত্রিকায় নজরুল আগুনঝরা সব সম্পাদকীয় লিখে ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েন। জোরালো লেখার গুনে প্রথম দিনেই কাগজটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

নবযুগে গরম লেখার কারণে তিনবার সরকার তাদের সতর্ক করেছিল। প্রথম সতর্ক করেছিল ‘মুজাহিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধের জন্য। প্রবন্ধটি বলাই বাহুল্য নজরুল ইসলামের লেখা। তবে খিলাফত কমিটির একটি ইশতেহার ছাপানোকে কেন্দ্র করে জামিনের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। যদিও ইশতেহারটি ‘বসুমতি’সহ অন্যান্য পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু জামানতের টাকা কেড়ে নেওয়া হয় নবযুগের। যেদিন সকালে পত্রিকার হাজার টাকা জামিন বাজেয়াপ্ত হওয়ার খবর এলো, তখন তারা ভেবেছিলেন বিকেলে হয়তো পত্রিকা বের করতে দেওয়া হবে। কিন্তু তা হলো না। তখনকার দিনে প্রেস আইন অনুসারে, এক হাজার টাকা কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে জমা রেখে কাগজ বের করতে হতো। তখন এক হাজার টাকা জামিন বাজেয়াপ্ত হলে দুই হাজার টাকা পুনরায় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জমা দিয়ে পুনরায় কাগজ বের করতে হতো। কিন্তু এ কে ফজলুল হকের কাছে তখন অত টাকা ছিল না বিধায় তিনি টাকা জমা দিতে গড়িমসি করছিলেন। শেষে একজন বড় ব্যবসায়ীকে একটা চিঠি লিখে দিলে তিনি জামানতের টাকাটা দিয়ে দেন। 

কিন্তু নানা কারণে নজরুল ‘নবযুগ’ ছেড়ে চলে যান। এরপর নজরুলের ইচ্ছা হলো একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার। শুষ্ক আচার অনুষ্ঠানের বেড়াজাল ভেঙে নতুন চেতনায় সঞ্জীবিত করে তোলার জন্য তিনি তার সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ করতে উদ্যোগ নিলেন। তাকে তখন সহযোগিতা করেছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র হাফিজ মাসউদ আহমদ। যদিও তিনি কাগজ বের করার পক্ষে খুব কম অর্থ দিতে পেরেছিলেন। মাত্র আড়াইশ টাকা দিয়ে ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে প্রেসিডেন্সি আদালত থেকে ডিক্লারেশন নেন আফজালুল হক। ধূমকেতু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মাঝে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। যার জন্য এর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। 

সেখানে নজরুল লেখেন, “স্বরাজটরাজ বুঝি না। কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না, আমাদের এই প্রার্থনা ভিক্ষা করার কু-বুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। এ কথা পরিষ্কার যে, শুধু স্বাধীনতা নয়, দরকার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। আর আবেদন-নিবেদনে এই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটেই সম্ভব নয়।”

সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা এবং কংগ্রেসেরও নেতা ভূপতি মজুমদার ধূমকেতুকে সাহায্য করতেন নানাভাবে। তবে পুলিশের নজর ছিল ধূমকেতুর দিকে। ওই অফিসে কারা যাওয়া-আসা করেন, ধূমকেতুর পেছনে কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠছে কি না। কিন্তু শাসনের জন্য একা পুলিশ তো ছিল না। পুলিশকে বাদ দিয়েও বঙ্গীয় প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্ট ছিল। গভর্নমেন্টের বাংলা অনুবাদকের অফিসে নজরুলের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে হোম ডিপার্টমেন্টের পলিটিক্যাল সেকশনের অফিসারদের টেবিলে চলে যেত। লেখাগুলো পড়ে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১২৪ এর ধারা অনুসারে মোকদ্দমা করা হয়, যা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। প্রাদেশিক কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করা হয় সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রকাশক আফজালুল হকের বিরুদ্ধে।

আফজালুল হক যখন পুলিশের হাতে বন্দি হন তখন নজরুল কুমিল্লায় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাজনীতিবিমুখ আফজালুল হককে মুক্ত করতেই নজরুল পুলিশের কাছে ধরা দেন। বিচারের রায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪-এ ধারা অনুযায়ী নজরুল এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫