Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

আতঙ্কের শহর গাজীপুর

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০:৪১

আতঙ্কের শহর গাজীপুর

জনপদের নাম গাজীপুর, শিল্পঘন শহর হিসেবেই পরিচিত। ঢাকা থেকে উত্তরার আবদুল্লাহপুর পার হলেই টঙ্গী। গাজীপুর মহানগরীর সীমানা এখান থেকেই শুরু। পাঁচটি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই জেলার শিল্পাঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কলকারখানা রয়েছে, যার মধ্যে দুই হাজার ১৭৬টিই নিবন্ধিত। এই জেলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র এবং পোশাকশিল্পের একটি বড় হাব, দেশের পোশাকশিল্পের ৭৫ শতাংশ এখানে অবস্থিত বলে উইকিপিডিয়া উল্লেখ করেছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) অধীন এলাকার আয়তন ৩৩০ বর্গকিলোমিটার। সেখানে বসবাস করে ৩৫ লাখের মতো মানুষ। দেশের রপ্তানি খাত ও অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য গাজীপুর গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন এলাকা। কিন্তু সেখানে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ গুনতে থাকে আতঙ্কের প্রহর। এ শহরের মানুষ যেন সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে ভয় পায়। রাতে জরুরি কাজেও বাইরে কেউ আসতে চায় না। এলেও ভয়ে হিম হয়ে রাস্তায় চলাচল করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক বিরাজ করছে বেশ কিছুদিন ধরে।

গাজীপুর শহরে এর আগে অপরাধ হয়নি এমন নয়। কিন্তু বর্তমানে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তাহীনতার চিত্র যেন নিত্যদিনের পরিস্থিতি। গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) অধীন এলাকায় একের পর এক ছিনতাই হচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় চলাচলে আতঙ্ক তৈরি হয়। চাঁদাবাজি, অপহরণ ও ধর্ষণ বেড়েছে। খুন হচ্ছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে দুই কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই স্টেশন রোড এলাকা। এটি থানার পাশে হলেও অপরাধীদের যেন নিরাপদ স্থান। সেখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়ও অপরাধীদের রাজত্ব। ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা মইজুদ্দিন বলেন, নগরীর চিহ্নিত কয়েকটি এলাকাকে অপরাধীরা স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে। ছিনতাই, চুরি, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্যের লড়াই এখানকার নৈমিত্তিক ঘটনা। তবুও টহল পুলিশের সংখ্যা বাড়ছে না। ফলে এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। 

গাজীপুরের স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অপরাধীরা কারা, কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কারা-এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা দরকার। অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা জরুরি। একই সঙ্গে এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ অপরাধ ঠেকাতে পারছে না। পুলিশের তৎপরতা, টহল ও তল্লাশিচৌকি নেই বললেই চলে। এই সুযোগে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মহানগরীতে আটটি থানা রয়েছে। এসব থানা এলাকায় গত সাত মাসে ৪৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের মামলা হয়েছে মহানগরের সদর থানায়। গত সাত মাসে এ থানায় ১১টি হত্যা মামলা হয়েছে। চলতি বছরের সাত মাসে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা কয়েক গুণ বেড়েছে। পুলিশের তথ্য মতে, টঙ্গী উড়াল সড়ক, টঙ্গী স্টেশন রোড, চান্দনা চৌরাস্তা, জয়দেবপুর ও কোনাবাড়ী, কাশিমপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব এলাকায় প্রায়ই ঘটছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যার মতো ঘটনা। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে বড় সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়া, পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতা ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যতম।’ তবে এটাই শেষ কথা নয়। গাজীপুরের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কতগুলো কিশোর গ্যাং। কিশোর গ্যাংয়ের এই ভয়াবহ উত্থানে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত এলাকাবাসী। বিশেষত, সন্ধ্যা নামলেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধারালো অস্ত্রের মুখে রিকশা বা অটোরিকশার গতিরোধ করে টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়। কখনো অন্ধকারে পথ আটকে, কখনো আবার থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয় মুঠোফোন ও গয়না। বাধা দিলে ছুরিকাঘাত করা হয়। গত ১১ জুলাই রাতে মহানগরের টঙ্গী সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের সামনে ছিনতাইকারীরা কলেজ শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। সম্প্রতি এরা কোনাবাড়ীর জরুন এলাকার নাসির পালোয়ানের (৯০) কাছে চাঁদা দাবি করে আসছিল। চাঁদা না দেওয়ায় এরা গত ২৭ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বৃদ্ধের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালায়। এ সময় নাসির পালোয়ানের মাথায় কোপানো হয়। হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২ জুলাই রাতে তিনি মারা যান। এই ঘটনার পর এলাকাবাসী খুবই সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। কারণ এরা এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে, তারা কোনো কথা না শুনেই হামলা করে বসছে। সম্প্রতি যে হত্যাকাণ্ডটি গোটা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে সেটি সাংবাদিক তুহিন হত্যা। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সাত আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা করে। একটা মানুষকে প্রকাশ্যে খুন করার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কী হতে পারে। সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের অন্যান্য মানুষের চেয়ে সাহসী মনে করে। কারণ তারা বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে। তাদের কাছে থানা পুলিশ কঠিন বিষয় নয়। কেউ সংকটে পড়লেও সাংবাদিকদের শরণাপন্ন হয়। সেই সাংবাদিকরা যখন প্রকাশ্য হত্যার শিকার হয় তখন মানুষের নিরাপত্তা শঙ্কা কতটা বাড়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সাধারণত শিল্পাঞ্চলগুলোতে এক ধরনের মাসলম্যানদের দৌরাত্ম্য থাকে। মালিকের লোক থাকে, আর শ্রমিকদের তো হারানোর কিছু নেই। তারা যেকোনো সময়ই লড়তে তৈরি থাকেন। ফলে এখানে এক ধরনের অপরাধ টিকে থাকেই। কিন্তু গাজীপুরের বর্তমান অবস্থা এসব নিয়ম-কানুনকে ছাড়িয়ে গেছে। জিএমপিতে বর্তমানে এক হাজার ৭৬৫ পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। মহানগরে আটটি থানা রয়েছে। কিন্তু পুলিশের তৎপরতার ঘাটতির কথা বলছে সাধারণ মানুষ। সাধারণত পুলিশের কাছে পেশাদার ছিনতাইকারীদের তালিকা থাকে। তবে জিএমপির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাজীপুরে কারা কোথায় ছিনতাই করে, সেই তালিকা তাদের কাছে নেই। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত গাজীপুর মহানগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

তাদের মধ্যে ২৪৯ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। যারা আটকে আছেন তারাও হয়তো আজ বা কাল মুক্তি পাবেন। কেউ না কেউ তো এদের বের করার জন্য চেষ্টা করবেন। কারণ এ কথা খুবই সহজ যে, অপরাধ যারা করে তাদের পেছনে কেউ না থাকলে বেশিদিন অপরাধী অপরাধ করতে পারে না। এ ছাড়া ছিনতাইয়ের মালামাল কেনার বাজার না থাকলেও ছিনতাই হবে না। তাহলে কারা পেছনে থেকে এই জনপদকে শ্বাসরুদ্ধকর এলাকায় পরিণত করছে, এটাই বের করা দরকার। এদের কারণে অপরাধী টিকে থাকে, টিকে থাকে অপরাধ। এই সংস্কৃতি টিকে থাকলে সমাজকে অপরাধ মুক্ত করা কঠিন। ভয়ের সংস্কৃতি এখানে পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। গাজীপুরের জনগণ বহুদিন ধরে আতঙ্কিত প্রহর কাটাচ্ছে। 

এ অবস্থায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসানের বক্তব্যের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডের পর নগরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সিভিল পোশাকে পুলিশ সদস্যরা নজরদারি করছেন। আমরা সব থানার ওসিদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছি। সেখানে সবাইকে সচেতন করা হয়েছে এবং কাজের নতুন পরিকল্পনা দিয়েছেন কমিশনার। কিন্তু তাতে শহরবাসীর ভেতর থেকে আতঙ্ক কাটছে না। যাদের কারণে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের লাখো মানুষ আতঙ্কের ভেতরে আছে, তারা কারা এটা জানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। রাজধানী সংলগ্ন একটি জেলা দিনের পর দিন কিছু সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে কেন-এ প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে সমাধান জরুরি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫