Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো কি অনিশ্চয়তায় পড়ল

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৪

ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো কি অনিশ্চয়তায় পড়ল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই দিন পরই সামান্য ঘটনায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ক্যাম্পাস। স্থানীয়দের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থীরা। ঘটনার পর ক্যাম্পাসে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সব ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে প্রশাসনিক ভবনে নিয়োগ পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। চাকসু নির্বাচনের সঙ্গে দৃশ্যত এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সামান্য একটি ঘটনা কেন এতদূর গড়াল এবং ক্যাম্পাসে সেনা মোতায়েনের মতো যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তাতে কিছু প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। প্রায় দুইশ শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ‘বহিরাগতরা’। ঘটনার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তৈরি নানা অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কেটে গেল তা বলা যাচ্ছে না। কয়েক দিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলছে, কোনো না কোনো অজুহাতে ডাকসু নির্বাচন আটকে যেতে পারে বা দেওয়া হতে পারে।

অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসু নির্বাচন নিয়েও। ৩১ আগস্ট বিকেলে ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে নির্বাচন কমিশন। তবে সভা শুরুর কিছুক্ষণ পরই আলোচনা বয়কট করেন ছাত্রদল নেতারা। তৈরি হয় হট্টগোল। এরপর অন্যান্য ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষার্থীরা জানান, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটার করতে আপত্তি নেই তাদের। কিন্তু কোনোভাবেই ভোট পেছানো যাবে না। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর রাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। যদিও এ পর্যন্ত তিনবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন ২৫ সেপ্টেম্বরেও হবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু নানা অজুহাতে বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন হয়নি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগরসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ওঠে। বুয়েট ও কুয়েটসহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠলেও সেসব জায়গায়ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার। এ রকম বাস্তবতায় ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় উচ্ছ্বাস। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে দোলাচল।

এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, যারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণ চায় না; গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে নিজেদের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সাংগঠনিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়, তারা নানাভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চাইবে। তা ছাড়া কোনো একটি দল যদি মনে করে যে তারা নির্বাচনে হেরে যাবে, তখন তারাও নির্বাচন বানচালের নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। যে কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই দিন পরই কেন একটি সাধারণ ঘটনায় স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘাত তৈরি হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

এটা ঠিক, যেকোনো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা বা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, তেমনি ইভ টিজিং, খেলার মাঠ ব্যবহার, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং সর্বোপরি নানাবিধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে অনেক সময় বিরোধও তৈরি হয়। কখনো সেই বিরোধ তীব্র সংঘাতে রূপ নেয়। তখন স্পষ্টতই স্থানীয় বাসিন্দা এবং শিক্ষার্থীরা দুটি পক্ষ হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সবশেষ যে ঘটনাটি ঘটল, তার সূত্রপাত একটি ছোট্ট ঘটনায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন একটি বাসায় একজন ছাত্রীর দেরিতে প্রবেশের চেষ্টা নিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয়। এরপর দারোয়ান তাকে চড় দিলে খবর ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। ধারালো অস্ত্র, ইট, পাথর ও লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় গ্রামবাসী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এই সংঘাতের পেছনে চাকসু নির্বাচনের যোগসূত্র আছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং সত্যিই এর পেছনে চাকসু নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। বিশেষ করে একটি ছোট্ট ঘটনা কেন এত বড় আকার ধারণ করল, কারা উসকানি দিল, এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে কি না, সেগুলো শুধু চাকসু নির্বাচনের স্বার্থেই নয়, বরং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্যও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিনও সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এখানে একটা চক্রান্ত হয়েছে। ঘটনাকে বড় করার জন্য যারা জড়িত ছিল তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যথেষ্ট তথ্য আছে। কারা কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনাকে পুঁজি করেছে সে তথ্যও আছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে কোনো নির্বাচন হয়নি। বরং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও চালাচ্ছেন অনির্বাচিত প্রশাসকরা। যে কারণে কোনো কোনো দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠানে দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে, তারা জাতীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবছে না।

তবে যারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল, তাদের একটা যুক্তি এই যে, এর মধ্য দিয়ে সরকার নিজেদের সক্ষমতা পরীক্ষা করতে পারত। এই সরকার যেহেতু গঠিত হয়েছে একটি বড় অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এবং এক বছর ধরেই দেশটা এক ধরনের বিশৃঙ্খলার মধ্যেই রয়েছে; ফলে তাদের পক্ষে এক দিনে ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচন করা কতটা সম্ভবপর হবে, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা গেলে সেটি সরকারের জন্য একটি অ্যাসিড টেস্ট হতো। কিন্তু সেটি যেহেতু হচ্ছে না, ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোও সরকারের সক্ষমতা প্রমাণের ছোট পরীক্ষা হতে পারে। কিন্তু কোনো না কোনো অসিলায় যদি এই নির্বাচনগুলোও অনিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে তার প্রভাব আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতি তো বটেই, জাতীয় নির্বাচনে কতটা পড়বে, সেটিও ভাববার বিষয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫