
লেখার প্রথম বাক্যটি শুনে রাগবেন না। ঢাকা শহর আমার ভীষণ ভালো লাগে, এই জন্য নয় যে এটা আমার জন্মের শহর, কোনো দিন গ্রামে ঈদ করতে যাই না টাইপের, কোনো টান নেই। গ্রাম বাংলাদেশের ও তার ইতিহাসের প্রধান শক্তি। আমার গবেষণার মূল পরিসর গ্রাম, অতএব বারবার গেছি। কিন্তু আমি শহরে বড় হওয়া-টিকাটুলি, মগবাজার, জিগাতলা, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, নিকেতন ইত্যাদি-তাই ওদের চিনি যেভাবে মানুষ নিকটজন চেনে। শহর আমার আত্মীয়স্বজনের মতন, বন্ধুর মতন। যাদের সঙ্গে বহু বছর দেখা না হলেও দেখা হওয়া মাত্র আপনজন হয়ে যায়। সে রকম সম্পর্ক আমার শহরের সঙ্গে। শহরে ভাড়াটে হিসেবে থাকার কষ্টগুলো চিনি, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। এই শহর আমার শহর, এটাই আমার ঠিকানা।
দুই
বাবার কালে আমি গাড়িতে চড়েছি। বাবার দীর্ঘ চাকরি জীবনে অফিসের গাড়ি ছিল, অতএব স্কুল-কলেজ এমনকি ভার্সিটিতে অনেক সময় বাবা ড্রপ করে দিয়েছেন। কিন্তু রুজির দুনিয়ায় এসে ২০০২-০৭ এবং ২০১২-১৭ অর্থাৎ এই ১০ বছর বাদে আমি হলাম বাস, রিকশা বা সিএনজি পার্টি। অথবা হাঁটি। সবচেয়ে ভালো লাগে রিকশা। কোথাও শুধু যাওয়া যায় না, সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায়। শুধু যাত্রা নয়, সাইট সিয়িং ট্যুর। তাই রিকশাই আমার প্রধান বাহন, এতে চড়েই আমি এই শহর দেখি, ভালো লাগায় ভরে যায়। নানা কাজের জায়গায় যাই এতে করে। যখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ছিল মহাখালী, আমি মেইন রাস্তার জ্যাম দেখতাম। এখন ক্যাম্পাস মেরুল বাড্ডা। গলি, উপগলি তার উপরে আরো গলি বেয়ে যাই স্টুডেন্ট পড়াতে, ভালো লাগে। আর ওর মধ্যেই খুঁজে পাই এক অদ্ভুত দুনিয়া।
তিন
নিকেতনের নিয়ম-কানুন মানা সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং ফেলে রেখে, গাড়ি আর বাইক বোঝাই রাস্তা পার হয়ে, পুলিশ প্লাজা থেকে একটা রিকশা নিয়ে হাতিরঝিল পার হলেই অন্য ঢাকা। ওটা তখন আর ভদ্রলোক সুশীল থাকে না। রাস্তা ভাঙাচোরা, চারদিকের বিল্ডিংগুলো কোনোটা উঁচু, কিন্তু তার মাঝেই আবার দু-তিন তলা ছোট বাড়ি।
দোকানগুলো আর এত ছিমছাম নাই। বড় কাবাবের দোকান আছে, কিন্তু সঙ্গে জীর্ণ জিলাপির দোকান। কিন্তু এই দৃশ্য বেশিক্ষণ না। রিকশা যেই দারোগা বাড়ির গলিতে প্রবেশ করে, অমনি অন্য ঢাকায় পৌঁছায়, আসল গলির ঢাকায় প্রবেশ ঘটে। দারোগা বাড়ি নিজেই এই রহস্যময় গলির দুনিয়ার একটা ভালো প্রতীক। যেখানে জমির দাম কয়েক কোটি কাঠাপ্রতি, সেখানে আধা বিঘা জমিতে পরে রয়েছে টিনের চালের বড়সর পড়ো ঘর। মালিকরা কেউ থাকে না, তবে কাপড়চোপড় শুকাচ্ছে নজর আসে মাঝে মাঝে। কিন্তু কেউ বাড়ি করেনি কেন? কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ফেলে রেখেছে কেন? কোনো উত্তর নাই। আর ওটাই ভালো লাগে। গলির ভেতর প্রশ্ন করা যায়, সব উত্তর পাওয়া যায় না।
চার
গলিতে এক ইঞ্চি জমি বাদ নাই, যে যেটা পেরেছে তুলেছে। এক, দুই, তিন, দশ তলা, সব আছে। কোনো বাড়ির চেহারা আধুনিক, আয়না দেখা যায় দেওয়ালে, কোনোটার একতলায় কে থাকে বোঝা যায় না। তারপর হঠাৎ করেই সারি সারি টিনের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো নিম্নবিত্ত, কাপড়চোপড়ে বোঝা যায়, কিন্তু এই স্থানে থাকে কেন? বিক্রি করে চলে যায় না কেন? আর এই জমিতে কেউ বাড়ি করেনি কেন? এরা করেনি কেন? আমি মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছি, উত্তর পাইনি। জমির ঝামেলা, মামলা, দখল? সদুত্তর নাই। গলির কোনার বাড়িটা তিন কোনা, এত জীর্ণ আর নোংরা লাগে, কিন্তু দুটি এসি লাগানো। কে থাকে এমন সরু, সংকীর্ণ বাড়িতে এসি লাগিয়ে? পাশেই একটা ঝকঝকে আটতলা অট্টালিকা, ডেভেলপারের সাইন বোর্ড লাগানো। কে থাকে গলির এত গভীরে এসে? মেইন রোডে নয় কেন? কেমন জীবন যাপন? জানা হয় না।
কখনো কখনো যখন রাতে ক্লাস থেকে ফিরি, হেঁটে বা রিকশা করে ৯টার অনেক পর, তখন কেবল বাড়ির আলো দেখতে পাই, জানালার বাসিন্দা নয়। ছায়াদের রাজত্ব তখন। ওই বাড়িতে কি দিনের বেলা কেউ থাকে না? রাত্রি হলে অন্য কোনো বাসিন্দারা নামে মেরুল বাড্ডার গলিতে। বাড়ির সঙ্গে বাড়ি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, যেন মিছিল মিটিংয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, বলছে : আমরা আছি একসঙ্গে। তাদের কী দাবি?
পাঁচ
গলির ভেতর কফি শপও পাওয়া যায়, কিন্তু বেশি আছে পুরি-শিঙাড়ার দোকান, অ্যালমুনিয়ামের থালায় নাশতার পসরা, মানুষ আসে, খায়, নেয়, চলে যায়। কেউ খালি হাতে ফেরত যায় না। দোকানের সাইন বোর্ড কোনোটার আছে, কোনোটার নেই, দরকার নেই। সবাই তো সবাইকে চেনে যেন। একবার জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘দোকান করতে কী লাগে আপনাদের’? আমাকে দুইটা সমুচা পার্সেল করতে করতে বলল, ‘মানুষরে চিনলেই হয়, কত মানুষ ...’।
হয়তো ওটাই আসল কথা, চেনাটা। আধা বানানো বাড়িতে মানুষকে থাকতে দেখা যায়, হঠাৎ হুট করে কোনো বাড়ি থেকে বের হয় দামি গাড়ি, ট্রাফিক জ্যাম বানায়। বড়লোক এখানে থাকে কেন? জ্যামে আটকে ভাবি, এখানে বোধহয় ঢাকা শহর এসে একটু বিশ্রাম নেয়, অন্য কোন শহর তার বদলে গলির ভেতর বসবাস করে।
ছয়
একদিন রাতে ফিরছি আলো-আঁধারির গলি দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়, কিন্তু সবই ছায়া মেশানো। রিকশার বেলের আওয়াজ, স্কুটার সিএনজির হেডলাইট, দোকানের বাল্ব সব কিছুই ঝাপসা আর সাময়িক লাগে চোখে। অন্য কোনো সময়, অন্য কোনো কালে হাঁটছি যেন। যেন সময় হার মেনে বসে আছে কোনো গলির বাঁকে। তখন যে উপলব্ধিটা হয়েছে আমার সেটা হলো ঢাকার গলি কাউকে ফেরায় না, সবাই সবকিছুকে জায়গা, পরিসর দেয়ই। যেকোনো যানবাহন পাশাপাশি চলতে পারে না বলেই সাইড দিতে হয়, মানুষেরা হাঁটে একইভাবে গলির ভেতর। এত কিসিমের বাড়ি মেইন রোডে পাওয়া যায় না, এত রকম মানুষ তো নয়ই। হয়তো এত রকম সময়, কাল, ইতিহাস। গলি যেন এক সংসারী মাতা, যেসব কিছু আগলে রেখে, সবাইকে জায়গা দিয়ে নিজে টিকে থাকে আলিঙ্গনের শক্তিতে।