Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

পরিবারতন্ত্র বনাম গরীবের রাজনীতি

Icon

কবীর আলমগীর

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২৭

পরিবারতন্ত্র বনাম গরীবের রাজনীতি

আক্ষরিক অর্থে পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কেউ নেতা হয়েছেন বাবার উত্তরসূরি হিসেবে, কেউ মা, কেউ ভাই, কেউ দাদা, কেউ বোনের সূত্রে। ফলে রাজনীতিতে একই ছক, ছন্দ ও ধন্দ। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণদের মধ্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ বেড়েছে বলা যায়। যারা মূলধারার রাজনীতিতে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন। তাদের কোনো ভণিতা নেই। রাজনীতির ছদ্মাবরণ এদের স্পর্শ করেনি। এরা কেউ কৃষকের ছেলে, কারো বাবা ছোটখাটো চাকরি করেন কিংবা ব্যবসা। এই তরুণরা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বলয় ভাঙতে চান। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে এই তরুণদের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব স্পষ্ট।

এই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার সাম্প্রতিক মন্তব্যে। নির্বাচন কমিশনে রুমিন ফারহানার সঙ্গে বিএনপির অন্যপক্ষের সংঘর্ষের ফলে সেখানে মারধরের শিকার হন এনসিপি নেতা মো. মহিবুল্লাহ। প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ মন্তব্য করেন ‘রুমিন ফারহানা আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।’ এই মন্তব্যের পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক কারণও আছে। এক টকশো অনুষ্ঠানে রুমিন ফারহানাকে বলতে শুনেছি, আওয়ামী লীগের জাঁদরেল এমপি শামীম ওসমান পরিবারের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্কের কথা। আওয়ামী লীগের আমলে ফাঁকফোকরযুক্ত নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের সংসদ সদস্য হয়ে বিএনপির যে কয়জন পার্লামেন্টে গিয়ে নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছিলেন তার মধ্যে রুমিন ফারহানা একজন। তার বাবা অলি আহাদ ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক (পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন)। সুতরাং আওয়ামী পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। 

রুমিন ফারহানা অভিজাত পরিবারের মেয়ে, বাবা রাজনীতিবিদ ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত এই নারী রাজনীতিতে আসেন বাবার পরিচয়ের সূত্র ধরেই। কিন্তু লন্ডন পাস করা কন্যার শব্দচয়ন অগ্রহণযোগ্য লেগেছে। হাসনাত আবদুল্লাহকে রুমিন ফারহানা অভিধা দিয়েছেন ‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বলে। এই ধরনের শব্দচয়নের পেছনে কাজ করে পরিবারতন্ত্র ও বুর্জোয়াতন্ত্রের প্রভাব। মগজে যদি বুর্জোয়াতন্ত্র থাকে তবে ‘ফকিন্নির বাচ্চাদের’ রাজনীতি অসহ্য লাগারই কথা। তখন প্রকট হয়ে ওঠে শ্রেণিদ্বন্দ্বের রাজনীতি। 

রুমিন ফারহানার এই উচ্চারণ নিম্নবর্গ কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত বর্গকে রাজনীতিতে মেনে না নেওয়ার লক্ষণ। রুমিন ফারহানার এই অবস্থানের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় বাংলাদেশের বিগত রাজনীতি আসলেই পরিবারতন্ত্রের, ধনিক শ্রেণির জায়গা। এখানে টাকার বিনিময়ে নেতা হওয়া যায়, আসন কিংবা ভোট কেনা যায়। সুতরাং রাজনীতি, টাকা ও পরিবারতন্ত্র এক হয়ে বাংলাদেশে সর্বনাশাত্মক এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে।

আগেই বলেছি, তরুণদের কেউ অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে। বিশ্বরাজনীতিতে এমন অনেক নেতা ছিলেন, যারা জন্মেছেন দারিদ্র্যের মধ্যে, কিন্তু কঠোর সংগ্রাম, মেধা ও দৃঢ় নেতৃত্ব গুণের মাধ্যমে শুধু দেশের নয়, বিশ্বের কাছে হয়েছেন অনুকরণীয়। তাদের জীবনকাহিনি শেখায় দারিদ্র্য কখনো নেতৃত্বের পথে বাধা নয়, বরং একে জয় করার অদম্য প্রেরণা হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন জন্মেছিলেন এক দরিদ্র 

কৃষক পরিবারে। শৈশবে তাকে মাঠে, এমনকি কাঠ কাটার কাজও করতে হয়েছে। তবুও অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনিই উচ্চারণ করতে শিখিয়েছেন, গণতন্ত্র জনগণের শাসন, জনগণের জন্য। 

দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই তাকে জীবনের নানা অভাব-অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়। বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের ২৭ বছর কাটাতে হয় কারাগারে। তবুও তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন স্বাধীনতা ও সমতার রাজনীতিতে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা দরিদ্র শ্রমিক পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় তিনি জুতা পলিশের শ্রমিক ছিলেন, কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তার শিক্ষাজীবনও সীমিত ছিল। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ‘ফ্রন্টিয়ার গান্ধী’ নামে পরিচিত খান আব্দুল গফফার খান ছিলেন পশতুন অঞ্চলের এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শিক্ষার প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল এবং ব্রিটিশবিরোধী অহিংস আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। অবদান রাখেন সামাজিক রাজনীতিতে।

বাংলাদেশের ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে কথিত ‘ফকিন্নির বাচ্চারা’ ছিলেন রাস্তায়। তাদের স্লোগানে ভিত নড়েছিল ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার মসনদে। গবেষণার তথ্য মতে, গণ-অভ্যুত্থানে ১৬৮ পথশিশু মারা গেছে। আমরা এদের বিস্তারিত পরিচয় জানি না, জানি না কার সন্তান, কবর কোনটি? আন্দোলনের সময় ছিন্নমূল মানুষ রাস্তায় ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, ফলে দমন-পীড়নের সময়ে তারা কাজ করেছেন আন্দোলনকারীদের জন্য ঢাল হিসেবে। পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাবের দমন অভিযানে এই ‘ফকিন্নির বাচ্চারা’ নিজেরাই লাঠি, ইটপাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অনেক পথশিশু আন্দোলনের স্লোগানে মুখে মুখে ছড়িয়েছে, প্ল্যাকার্ড বহন করেছে বা পতাকা হাতে মিছিলে হেঁটেছে। আমরা তাদের অবদান নতজানুচিত্তে স্মরণ করব, নাকি গালি দেব!

গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায়ই পারিবারিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রথমত, এটি রাজনীতিতে নতুন এবং প্রতিভাবান ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার সীমিত করেছে। যারা রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য নন, তাদের জন্য উচ্চ পদে আসীন হওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক সময় পারিবারিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থ জনস্বার্থের ওপর প্রাধান্য পায়, যা সুশাসন ও স্বচ্ছতাকে ব্যাহত করে। তৃতীয়ত, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। কারণ শীর্ষ নেতৃত্ব প্রায়ই পরিবারকেন্দ্রিক হয় এবং দলের মধ্যে ভিন্নমত বা নতুন নেতৃত্বের উত্থানকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে দলগুলো এক ধরনের স্থবিরতার মধ্যে পড়ে। 

কেউ কেউ দাবি করতেই পারেন এই পরিবারভিত্তিক উত্তরাধিকার একাধারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছে। এটি হয়তো কিছুটা সত্য, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রের সুস্থ ধারা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এই প্রতিবন্ধকতা উতরে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে বর্তমানের রাজনীতি সচেতন তরুণরা। ফলে নতুন নেতৃত্বকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলো এবং তাদের দীর্ঘদিনের প্রভাব, অর্থ, ক্ষমতা তাদের লড়াইকে কঠিন করে তুলেছে। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলোই তাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করছে এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছে। 

সাধারণ মানুষ ক্রমে এমন নেতৃত্ব চাইছেন, যারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো বোঝেন এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন। বর্তমান তরুণ ও যুবসমাজ রাজনীতি সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণ নেতাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া ও জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদি এই তরুণ নেতৃত্ব তাদের মেধা, যোগ্যতা এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করতে পারে, তবে রাজনীতি হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত, বহু স্বরের মিশ্রণ। 

রাজনীতিকে শুধু অভিজাতদের ক্ষেত্র হিসেবে দেখলে তা জনগণের স্বার্থবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। কারণ রাজনীতির প্রকৃত শক্তি জনগণের হাতে। সাধারণ মানুষই রাজনীতিকে জীবন্ত রাখে। তরুণদের সামনে যদিও অনেক প্রলোভন, অনেক ফাঁদ পাতা। এসব কাটিয়ে যদি তরুণ প্রজন্ম বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে, তবে রাজনীতিতে নতুনত্ব আসবেই। তখন প্রমাণ হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি কেবল ব্যারিস্টারদের জন্য নয়, ‘ফকিন্নির বাচ্চাদের’ও এখানে সমান অধিকার রয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫