Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

আর কোনো নাগরিক যেন গুম না হয়

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০৯

আর কোনো নাগরিক যেন গুম না হয়

গুম বলতে সাধারণত জোরপূর্বকভাবে কাউকে অপহরণ, আটক এবং তার কোনো খোঁজ না রাখার ঘটনাকে বোঝানো হয়। যেখানে রাষ্ট্র বা সরকারি কোনো সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয়, প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন করা হয়, কখনোবা হত্যা করে লাশ পর্যন্ত গুম করে ফেলা হয়। ভুক্তভোগীর মৃত্যুর কোনো প্রমাণ থাকে না বা রাখা হয় না। যে কারণে হত্যাকারী পক্ষ ঘটনা অস্বীকার করতে পারে। এই ঘটনায় ভিকটিমকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বেআইনিভাবে আটক রাখার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। গুম একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশে অজস্র গুমের ঘটনা এর আগে ঘটেছে। আমাদের অনেকেরই মনে আছে, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী অপহরণের কথা। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলী অপহরণ ছিল বাংলাদেশের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এবং দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে তার গাড়িচালকসহ ঢাকার বনানী থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। 

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম এক নিয়মিত চর্চিত শব্দে পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সমালোচক কিংবা ভিন্নমতের মানুষকে বিভিন্ন সময়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তাদের কারো কারো লাশ পাওয়া গেলেও অনেকের এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। যারা গুম হয়েছেন, যাদের পাওয়া যায়নি বা আয়না ঘরে ছিলেন, সরকার কি এদের ভয় পেত? একটি সরকার যদি অন্যায় করে, নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নেয়, এ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যাদের হুমকি মনে হয়, তাদেরই সরিয়ে ফেলতে চায়। এভাবে একজন-দুজন করে শত শত মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তবু পরিবার-পরিজন সারা জীবন অপেক্ষা করে। যে অপেক্ষার কোনো শেষ থাকে না। যে কারণে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি গুমের পরিসংখ্যান।

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩০০ জন। তাদের অনেকেরই ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছে কমিশন। তাদের পরিবারগুলোর অপেক্ষার যেন শেষ নেই। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ১২ বছর আগে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর গুম হন লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম (হিক)। একই সঙ্গে নিখোঁজ হন দলের লাকসাম পৌরসভার সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির (পারভেজ)। হুমায়ুন কবিরের ছেলে শাহরিয়ার রাতুল গত ২৯ আগস্ট গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘বাবা নেই, এটা এখনো মাথায় নিতে চাই না। এর পরও যদি আল্লাহ তার হায়াত না রাখেন, তিনি বেঁচে না থাকেন, সেটা জানলে অন্তত মনটাকে বোঝাতে পারতাম। যে জায়গায় তার দেহাবশেষ আছে, সেখানে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে বাবার জন্য দোয়া-দরুদ পড়তে পারতাম।’ 

২০১০ থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর নেতাকর্মী অথবা বিরোধী মতের মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করে গুম করার প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে ব্যাপকভাবে গুমের ঘটনা ঘটতে থাকে। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। প্রথম পরিণতি ছিল ভুক্তভোগীকে তুলে নিয়ে হত্যা এবং লাশ গুম করে দেওয়া।

 অন্যদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো, সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দিয়ে গ্রেপ্তার করানো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্পসংখ্যক মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হতো। এ ছাড়া ভারত সরকার এ কাজে যে আওয়ামী লীগ সরকারকে সাহায্য করত তার অনেক নজির আছে। অনেককে ধরে ভারতের অংশে ঢুকিয়ে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে দেওয়ার পর তারা বিভিন্ন জেলে আটকে রাখত। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির উত্তাল সময়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঢাকাস্থ উত্তরার একটি বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে অচেনা মুখোশধারী অপহরণকারীরা সালাহউদ্দিন আহমদকে চোখ বেঁধে গুপ্ত স্থানে তুলে নিয়ে যায়। তখন থেকে ৬২ দিন অজ্ঞাত স্থানে গুম থাকার পর একই বছরের ১১ মে সালাহউদ্দিন আহমেদকে সর্বপ্রথম মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের গলফ লিংক মাঠে পাওয়া যায়। মেঘালয় রাজ্যের পুলিশ ২০১৫ সালের ৩ জুন ভারতে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগ এনে বৈদেশিক নাগরিক আইনের ১৪ ধারায় সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রথমে হাসপাতালে চিকিৎসা ও পরে শিলং জেলে পাঠান। এ রকম অনেক কাহিনি আছে। এই ধরনের একজন ব্যক্তিকে যদি মেঘালয়ে জেল খাটতে হয় তাহলে বুঝতে হবে, ভারতের কত লোক কোন জেলে আছে। কিন্তু শুরু থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই ঘটনাগুলো অস্বীকার করে আসছিল। উল্টো ভুক্তভোগীরা ‘পাওনাদারের ভয়ে পালিয়েছেন’ বা আত্মগোপনে আছেন, এমন অমর্যাদাকর বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হারিয়ে যাওয়া, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনরা খোঁজ শুরু করে। এরপর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, যার সভাপতি করা হয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। কিন্তু নিখোঁজ বেশির ভাগ ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করছে গুম কমিশন। তবু খুঁজে পাওয়ার সব ধরনের চেষ্টা করছে তারা। আওয়ামী সরকারের পতনের পর গোপন বন্দিশালাগুলো থেকে অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন। এ জন্য এখনো যারা ফেরেননি, তারা আর বন্দি নেই, এটা নিশ্চিত বলছেন অনেক দায়িত্বশীলরা। তার পরও বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান সবাই অপেক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক। 

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গুমের ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৮৫০ অভিযোগ পেয়েছে তারা। এর মধ্যে একাধিক মাধ্যমে অভিযোগ করায় কিছু অভিযোগ দুইবার এসেছে। এমন অভিযোগগুলো বাদ দিলে এক হাজার ৭০০টির বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার তদন্ত করতে গিয়ে নতুন অনেক ঘটনাও সামনে আসছে, যেগুলোতে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত শেষ করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে চায় কমিশন। এরই মধ্যে সরকারকে কমিশন দুটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দিয়েছে। ভুক্তভোগীরা এখনো এক ধরনের ভয়ের মধ্যে আছেন বলে জানিয়েছেন কমিশনের একাধিক সদস্য। গুম হওয়া ব্যক্তিদের তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে তদন্ত কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই ১০, ১২, ১৪ বছর ধরে কোনো খোঁজ নেই। আইন অনুযায়ী, সাত বছর কেউ নিখোঁজ থাকলে ধরে নেওয়া যায় সে আর বেঁচে নেই। তবু খুঁজে পাওয়ার সব ধরনের চেষ্টা করছে কমিশন। আমাদের প্রত্যাশা, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে স্পষ্ট বার্তা আসবে যে, আর কোনো নাগরিক গুম হবে না। এমন ঘটনায় রাষ্ট্রের প্রতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে যায়। যেটা রাষ্ট্রকে অকল্যাণকর রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলে দেয়। মানুষকে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাই করে দেওয়া হবে, এটা হতে পারে না। গুম হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য যতটুকু পারা যায়, তা জোগাড় করতে পারলে পরিবারগুলো একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবে-এটার চেষ্টাও করা হোক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫