Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

হিমালয়ের দেশ নেপাল সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

Icon

ইশতিয়াক হাসান

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:১৭

হিমালয়ের দেশ নেপাল সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

নেপাল, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে, দুর্গম গুম্ফাগুলো মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে রহস্য গায়ে জড়িয়ে, আর ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে অজানা সব গল্প। নেপালের পাহাড়-নদী আর এখানকার জীবন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে একবারই। তবে এই মায়াবী দেশ আমার মনে বারবার হাজির হয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটির প্রতিটি পাহাড়ের চূড়া, নদীর স্রোত, লেকের নীরবতা, উপত্যকার ঘন জঙ্গল এবং মানুষের প্রতিটি গল্প ইতিহাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে-একটি জীবন্ত মহাকাব্য তৈরি করে। এখন নেপাল বিক্ষুব্ধ সময় পার করছে। বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। এই পরিস্থিতিতে দেশটির সৌন্দর্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের অসীম শক্তি সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। 

পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া থেকে গভীরতম উপত্যকা

এটি শুধু একটি পাহাড়ি দেশ নয়, বরং প্রকৃতির এক জীবন্ত নান্দনিকতা, যেখানে সাগর সমতল থেকে শুরু করে হিমালয়ের তুষার ঢাকা চূড়া পর্যন্ত এক অবিশ্বাস্য উচ্চতার পার্থক্য রয়েছে। দেশটি চীন ও ভারতের সীমান্তে অবস্থিত, আয়তনে  বাংলাদেশ থেকে সামান্য ছোট। কিন্তু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে 

পৃথিবীর অগ্রণী। স্থানীয়ভাবে ‘সাগরমাথা’ নামে পরিচিত মাউন্ট এভারেস্ট (২৯ হাজার ৩২ ফুট বা আট হাজার ৮৪৯ মিটার) নেপালেই। এটি শুধু পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নয়; বরং রোমাঞ্চ, স্বপ্ন ও মানুষের সীমারেখা পরীক্ষা করার প্রতীক।

শুধু এভারেস্টই নয়, বিশ্বের ১০টি সবচেয়ে উঁচু পর্বতচূড়ার আটটি নেপালে। কেবল উচ্চতা নয়, প্রতিটি শৃঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের কিংবদন্তি, অভিযাত্রীদের গল্প এবং নেপালের সংস্কৃতির অনন্য চিহ্ন। এ ছাড়া রয়েছে কালি গান্দাকি, পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর এই উপত্যকা, প্রায় তিন হাজার ৯০০ ফুট (এক হাজার ২০০ মিটার) গভীর। এই গিরিখাদের ধারে দাঁড়ালে মনে হয় যেন 

পৃথিবীর বুকের ভেতরে নেমে যাচ্ছি। আর কাজিন সারা লেক (১৭ হাজার ৬০ ফুট বা পাঁচ হাজার ২০০ মিটার) বিশ্বের উচ্চতম হ্রদগুলোর একটি। হিমালয়ের তুষার গলা জলরাশি বুকে ধারণ করে আছে আশ্চর্য সুন্দর এই হ্রদ।

হিমালয় কোটি বছর আগে গঠিত হয়, যখন ভারতীয় প্লেট এশিয়ার প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষ করে। এর শক্তি এতটাই বিশাল যে জমি ওপরে উঠে পাহাড়ে রূপ নেয়। প্রতিটি পর্বত কেবল উচ্চতা নয়, ইতিহাস ও কিংবদন্তির সাক্ষী। এখানকার প্রতিটি ঝরনা, গিরিখাদ, লেক ও গুহা একটি রোমাঞ্চকর গল্পের অংশ, যা শুধু চোখে দেখেই নয়, হৃদয়ে অনুভব করেও পাঠককে মুগ্ধ করে।

ইতিহাস : রাজপুত্র, বিদ্রোহ ও বিপ্লব

নেপালের ইতিহাস যেন এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চের গল্প; যেখানে রাজপুত্র, শাসক, বিদ্রোহী ও সাধারণ মানুষ মিলে সময়ের সঙ্গে লড়াই করে গেছে। ১৭৬৮ সালে গুরখা শাসক পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কাঠমান্ডু জয় করেন এবং ছোট ছোট এলাকা একত্রিত করে শক্তিশালী নেপালি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয় দেশকে এক করে রাখার সংগ্রাম এবং রাজশক্তির ধারাবাহিকতা। এরপর আসে ১৮১৪-১৬ সালের অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধ। শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে এই লড়াই শেষে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা নেপালের বর্তমান সীমারেখা নির্ধারণ করে। এ সময় নেপালের স্বাধীনতা এবং সীমান্ত রক্ষা-দুটোই বিপদে পড়েছিল।

১৮৪৬-১৯৫১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রানা শাসকেরা রাজবংশকে প্রভাবিত করে দেশকে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন রাখেন। রাজতন্ত্র থাকলেও বাস্তবে ক্ষমতা ছিল রানা পরিবারে, যারা দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিত।

২০ শতকের শেষদিকে নেপাল নতুন এক রূপ নেয়। ১৯৯৬-২০০৬ সালে মাওবাদী বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যেখানে জনগণ রাজতন্ত্রের পরিবর্তন চায়। এই সংঘাতে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ জীবন হারায়। একদিকে তীব্র সংঘর্ষ, অন্যদিকে মানুষের সাহস ও আশা-সব মিলিয়ে এটি নেপালের ইতিহাসে একটি গভীর ছাপ ফেলে। অবশেষে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং নেপাল হয়ে যায় ফেডারেল রিপাবলিক। এভাবেই প্রাচীন রাজপুত্রের দেশ ধীরে ধীরে উদারতা, গণতন্ত্র এবং পরিবর্তনের পথে এগোয়।

সংস্কৃতি ও মানুষের জীবন : দেবী থেকে পাহাড়ি শহর

নেপাল শুধু পাহাড়ি দেশ নয়, বরং সংস্কৃতির এক জাদুময় সংমিশ্রণ। প্রতিটি উপত্যকা, শহর, মন্দির ও লোককাহিনি যেন জীবন্ত ইতিহাস বয়ে নিয়ে আসে। নেপালের সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হল জীবন্ত দেবী কুমারী। ছোট মেয়েদের দেবীরূপে পূজা করা হয় এবং তারা শিশু বা কিশোরী অবস্থায় ‘কুমারী’ পদাধিকারী হয়। এই রীতি শুধু ধর্মীয় নয়, এটি নেপালের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অদ্বিতীয় অংশ।

নেপালের ত্রিভুজাকার পতাকাও অনন্য। এটি বিশ্বের একমাত্র ত্রিভুজাকার জাতীয় পতাকা। দুটি ত্রিভুজ নেপালের পর্বতগুলোকে নির্দেশ করে। ওপরের ত্রিভুজে আছে চাঁদ, নিচের ত্রিভুজে সূর্য। লাল রং বিজয় ও সাহসের প্রতীক, নীল বর্ডার শান্তি নির্দেশ করে। পতাকার আকার ও প্রতীকগুলো দেশের পাহাড়, সূর্য, চাঁদ ও মানুষের চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নেপালের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে।

রাজধানী কাঠমান্ডুকে বলা হয় ‘লিভিং কালচারাল মিউজিয়াম অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। সাতটি ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এই শহরের মধ্যে সংরক্ষিত, যা একে জীবন্ত ইতিহাসের জাদুঘরে পরিণত করেছে। প্রতিটি কোনা যেন গল্প বলছে। নেপালের লুম্বিনী হলো গৌতম বুদ্ধের জন্মভূমি। এখানে মায়া দেবী মন্দির এবং প্রাচীন জায়গাগুলো আজও ভক্ত এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। 

নেপালের মানুষ সাধারণত শান্তিপ্রিয়, অতিথিপরায়ণ ও বহুজাতিক। ৮০টিরও বেশি জাতি, ১২৩টি ভাষা এবং বহু ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে জীবন কাটায়। ধর্ম, ভাষা বা জাতি-নির্বিশেষে তারা সহমর্মিতা, সৌজন্য ও সামাজিক সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে আছে।

সাহসিকতা ও গুর্খা : শান্তির মাঝে অদম্য শক্তি

নেপালের মানুষ কেবল শান্তিপ্রিয় নয়, বরং সাহসিকতায় বিশ্বখ্যাত। পাহাড়, ঝরনা, নদী-সব জায়গায় তাদের শক্তি, ধৈর্য ও দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ পায়। বিশ্বখ্যাত গুর্খা সৈনিকরা এর এক নিদর্শন। তারা শৃঙ্খলাবদ্ধ, অত্যন্ত সাহসী ও যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ কৌশলী। ভয়কে পাশ কাটিয়ে সাহসিকতার এক অনন্য উদাহরণ তারা। হাজার বছর ধরে এই সাহসিকতা শুধু দেশকে নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও নেপালের সুনাম ধরে রেখেছে। পাহাড়ি, জনজাতি ও বহু 

সংস্কৃতির মিলন নেপালকে বিশেষ করে রেখেছে। বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষ মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করছে এখানে, আর একই সঙ্গে প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করে। এই মিলন, সাহস ও ধৈর্যই নেপালকে বিশ্বের চোখে এক অনন্য দেশ করে তুলেছে।

প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী : রোমাঞ্চকর এক পৃথিবী

নেপালের প্রকৃতি নিজেই এক অদম্য রোমাঞ্চ। পাহাড়, নদী, হিমবাহ, ঝরনা-সবকিছুই অভিযাত্রী ও পর্যটকের জন্য চ্যালেঞ্জ ও আনন্দের মিশ্রণ। চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্কে হারিয়ে যাবেন বন্যপ্রাণীর জগতে। বাঘ, একশৃঙ্গ গন্ডার, হাতির জন্য বিখ্যাত অরণ্যটি। পর্যটকরা সাফারি করে সহজেই দেখতে পারেন গন্ডারসহ বিভিন্ন প্রাণী।

সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্ক, মাউন্ট এভারেস্টসহ বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গগুলোর আবাস। হিমবাহের কোল, কূপধ্বনির শব্দ, বরফের মধ্যে লুকানো ঝরনা-সবই এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার অংশ। এবং অবশ্যই ইয়েতি বা বিগফুটের কথা বলতে হয়-হিমালয়ের রহস্যময় কিংবদন্তি। ১৯৫১ সাল, এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানোর একটা বিকল্প পথের খোঁজ করছিলেন বিখ্যাত পর্বতারোহী শিপটন ও তার দল। ওই সময় অদ্ভুত এক পায়ের ছাপের সামনে চলে আসেন। এর ছবিও তুলে নেন শিপটন। আর এভাবেই বলা, ইয়েতির কথা জানতে শুরু করে বিশ্ববাসী। ১৯৫৩ সালে স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগেও এভারেস্ট অভিযানে বড় পায়ের ছাপ দেখেছিলেন। সেদিন থেকেই এই রহস্য কল্পনাপ্রিয় ও অভিযাত্রীদের কৌতূহলকে আরো উদ্দীপ্ত করে। সত্যিই কেউ আজও নিশ্চিত নয়Ñইয়েতি কি আছে, নাকি শুধু কিংবদন্তি।

নেপাল শুধু পাহাড় নয়

নেপাল সবদিকেই বিস্ময়কর। দেশের সময়সূচিও আলাদা-নেপাল ৫৬ বছর ৮ মাস এগিয়ে আছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে, অর্থাৎ এখানকার দিনগুলো অন্য দেশগুলোর থেকে একধাপ ‘ভবিষ্যতের’ মতো।

নেপালের পাহাড়ি যাত্রা এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। কখনো হিমবাহের সাদা চাদরের মাঝে হেঁটে অনুভব করবেন প্রকৃতির নির্মম শক্তি, কখনো ঝরনার রিমঝিম শব্দ কানে বাজবে, আবার কখনো স্থানীয় লোকগল্প অতীতের রাজপথে নিয়ে যাবে। এসব অভিজ্ঞতা মিলে তৈরি করে এক মহাকাব্যিক দৃশ্য-যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও ইতিহাস একসঙ্গে বয়ে চলে।

সূত্র : বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিডস, রাস্টিক পাথওয়েজ, হিমালয়ান 

গ্লেসিয়ার ডট কম, উইকিপিডিয়া

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫