Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

বিএনপির সংকট ও রাজনীতি

Icon

ওয়াসিম ফারুক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪১

বিএনপির সংকট ও রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) একটি বৃহৎ শক্তি। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া দলটি দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে, সেই সঙ্গে তীব্র প্রতিকূলতার মুখোমুখিও হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিএনপিকে ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন হলো, দলটি কোন পথে হাঁটবে? তাদের সঠিক গন্তব্য কি কেবলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া, নাকি সাধারণ মানুষের মনের কাছাকাছি যাওয়া? বিশেষ করে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এই প্রশ্ন আরো প্রাসঙ্গিক; জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিএনপি কি সাধারণ মানুষের মাঝে বিশেষ জায়গা তৈরি করতে পেরেছে?

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন অসুস্থ। তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান লন্ডনে বসে দলের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা, নেতৃত্ব গুণ এবং রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তিনি কি সত্যিই বিএনপির পুনর্জাগরণের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম? নাকি তার নেতৃত্বই দলের দুর্বলতার অন্যতম একটি কারণ?

রাজনীতিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা কখনোই সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। উইনস্টন চার্চিল, অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, আব্রাহাম লিংকন, স্যার রবার্ট পিল ও সাইমন বলিভারের মতো অনেক সফল রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক উচ্চশিক্ষিত না হয়েও সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক কাঠামোতে শিক্ষাগত পটভূমি একজন নেতার চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এবং সমালোচকরা তারেক রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বিষয়টি বারবার সামনে এনে তার নেতৃত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন। এ ছাড়া তারেক রহমানের জীবনে পেশাগত অভিজ্ঞতারও অভাব রয়েছে। তিনি কোনো চাকরি বা ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এ ধরনের অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রয়োজন না হলেও বাস্তব জীবনের সমস্যা বোঝা ও সমাধান করার ক্ষেত্রে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তারেক রহমান গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবারে লন্ডনে যান। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। প্রায় দেড় যুগ ধরে প্রবাসে 

থাকার কারণে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবধারার বাইরে অবস্থান করছেন। 

প্রবাসজীবন বা কারাজীবন কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য প্রতিবন্ধকতা নয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল নেহরু বা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ কারাবাস ও প্রবাস জীবন কাটিয়ে সফলভাবে দেশে ফিরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ দেশের রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন, বিশ্ব গণমাধ্যমে দেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান তুলে ধরে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ তারেক রহমান লন্ডনের মতো কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরে থেকেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার ইস্যুতে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার বক্তব্য বা উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে বিএনপি বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর হারিয়েছে।

১৯৯০ সালে যখন বাংলাদেশ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল, তখন বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে তারেক রহমান কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন না। তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। সেই সময় তারেক রহমানকে বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হিসেবে দেখা যায়। তরুণ বয়সে ছাত্রদল বা যুবদলের রাজনীতি না করেই তিনি হঠাৎ করে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এ উত্থানকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলের প্রবীণ নেতারা অনেকটাই পারিবারিক সুবিধার ফলাফল হিসেবে দেখেছেন। এই কারণে তার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা সব সময় বিতর্কিত থেকে গেছে। দলের ভেতর একটি বড় অংশ তাকে স্বাভাবিক উত্তরসূরি হিসেবে মানলেও, বিএনপির অনেক প্রবীণ নেতা তার নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমনকি অনেকেই বিএনপির রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করে নিজেদের মতো রাজনীতি শুরু করেন।

একজন নেতার চারপাশের মানুষ তার মান ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটায়। একজন দক্ষ ও শক্তিশালী নেতা সব সময় যোগ্য, কর্মক্ষম ও কৌশলগত চিন্তাশীল সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করেন। যেমন-বিশ্বমানের ফুটবলার লিওনেল মেসির পাশে সব সময় দক্ষ খেলোয়াড়দের সমন্বয় থাকে। কিন্তু বিএনপির রাজনৈতিক চিত্র ভিন্ন। তারেক রহমানের চারপাশে যেসব নেতার উপস্থিতি দেখা যায়, তাদের অনেকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল, বিতর্কিত কিংবা গৎবাঁধা রাজনীতিরই প্রতিনিধিত্ব করেন। ফলে দলটির ভেতর নতুন প্রজন্মের মেধাবী নেতৃত্ব উঠে আসতে পারছে না। এ ধরনের নেতৃত্ব একটি দলকে দুর্বল করে তোলে। যেখানে সমালোচনার বদলে তোষামোদ প্রবল হয়, সেখানেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুণগত মান কমে যায়। বিএনপি বর্তমানে ঠিক সেই সমস্যার মুখোমুখি।

তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে কতটা শক্তিশালী হতে পেরেছে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ যখন স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশের গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার সম্পূর্ণরূপে কুক্ষিগত করে, তখন দেশের 

মানুষের অধিকার রক্ষায় বিএনপি তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। দেশের মানুষ যখন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী জোট সরকারকে প্রতিহত করতে রাস্তায় নামার নেতৃত্ব খুঁজছিল, তখন বিএনপি বারবারই ‘ঈদের পরের কঠোর আন্দোলনের’ আশ্বাস দিয়ে জাতিকে শুধু আশাহতই করেনি, বরং শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করতে সহযোগিতা করেছে। ফলে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েও সেই মহাসমাবেশ মুহূর্তে ভণ্ডুল করে দেয় আওয়ামী সরকার অনুগত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

এর আগেও ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলে। ওই আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হয়। বরং সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরই শেখ হাসিনা বেপরোয়া হয়ে পড়েন। 

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করে বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও সেই নির্বাচনে জোট বিশেষ কোনো ভূমিকা তো রাখতেই পারেনি, বরং দেশের সাধারণ ভোটারদের আশাহত করেছে। সেই সঙ্গে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রকে আরো পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের স্টিম রোলার বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর আরো প্রকট হয়। বিএনপির আন্দোলনের ‘ভুল কৌশল’ এবং নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করে যে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কতটা অদূরদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল এর একটি সামান্য প্রমাণ। সেখানেও ছাত্রদল নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি।

বাংলাদেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকই তরুণ। এই তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে দক্ষতা, সততা এবং আধুনিক নেতৃত্বের সন্ধান করে। তবে বিএনপির গতানুগতিক রাজনীতি, ৫ আগস্টের পর তাদের অনেক নেতাকর্মীর দখলদারি,  চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজকে বিষিয়ে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণরা রাজনৈতিক বিতর্কে সক্রিয় হলেও বিএনপিকে ঘিরে তাদের আগ্রহ যেন দিন দিন কমছে। এর দায় দলের নেতৃত্বকেই নিতে হবে। 

বিএনপির বর্তমান সংকট বহুমাত্রিক। দীর্ঘ রাজনৈতিক ব্যর্থতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা  ও জাতীয় রাজনীতির প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারা এই বহুমাত্রিক সংকটের কারণ। বিএনপিকে যদি রাজনৈতিকভাবে পুনর্জাগরণ ঘটাতে হয়, তবে পুরো নেতৃত্বকেই আত্মসমালোচনা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে, সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করতে হবে এবং রাজনীতিতে ইতিবাচক ও গঠনমূলক ধারা তৈরি করতে হবে। অন্যথায় বিএনপি কেবল অতীতের গৌরব নিয়েই স্মৃতিচারণা করবে। ভবিষ্যতের রাজনীতিতে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, সেটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫