
বাংলা ভাষা আমাদের জাতিসত্তার অন্যতম ভিত্তি। এই ভাষার প্রমিত রূপ কেবল একাডেমিক পরীক্ষায় সঠিক উত্তর লেখার জন্যই নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগ, পেশাগত উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্যাদা রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। প্রমিত বাংলা হলো এমন এক মানদণ্ড, যা দেশের প্রতিটি নাগরিককে একটি অভিন্ন ভাষাগত কাঠামোর মধ্যে যুক্ত করে। কক্সবাজারের মতো একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরীতে এই প্রমিত ভাষা চর্চার গুরুত্ব আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। কারণ এখানে শুধু দেশের নানা প্রান্ত থেকেই নয়, বিদেশ থেকেও প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক আসেন। পর্যটনকেন্দ্রিক এই অঞ্চলের মানুষের ভাষা যদি প্রমিত হয়, তাহলে পর্যটকদের সঙ্গে যোগাযোগ আরো কার্যকর, সুনির্দিষ্ট ও সম্মানজনক হবে।
কক্সবাজারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রমিত ভাষার ব্যবহার নিয়ে বাস্তব চিত্র খুব উজ্জ্বল নয়। অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, যা শিক্ষার্থীদের প্রমিত ভাষা চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে। পাঠদানের সময় উচ্চারণে টান, শব্দচয়নে আঞ্চলিক রূপ এবং বাক্য গঠনে কথ্য ভঙ্গি প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে। এতে শিক্ষার্থীরা প্রমিত ভাষার সঙ্গে যতটা পরিচিত হওয়ার কথা, ততটা হয় না। তাদের দৈনন্দিন জীবনের পারিবারিক ও সামাজিক যোগাযোগ প্রায় পুরোপুরি স্থানীয় ভাষায় হয়, ফলে প্রমিত ভাষা ব্যবহারের অনুশীলন সীমিত থাকে। এই অভ্যাস পরবর্তী সময়ে তাদের উচ্চশিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এবং জনসমক্ষে বক্তব্য দেওয়ার সময় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
পর্যটননগরী হিসেবে কক্সবাজারে প্রমিত ভাষা চর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্থানীয় অর্থনীতি। হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, ট্রাভেল এজেন্সি, বাজার এবং উপকূলীয় বিনোদনকেন্দ্রে প্রতিদিন শত শত পর্যটক স্থানীয় সেবা গ্রহণ করেন। এসব সেবায় যারা নিয়োজিত, তাদের কথাবার্তায় প্রমিত ভাষা থাকলে পর্যটকের কাছে তা কেবল সহজবোধ্যই হয় না, বরং সেবার মান সম্পর্কেও ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে। অন্যদিকে অস্পষ্ট উচ্চারণ, আঞ্চলিক শব্দ বা ভুল ব্যাকরণ ব্যবহারের কারণে পর্যটকের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে, যা সেবার মান নষ্ট করে এবং পর্যটন খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। আন্তর্জাতিক পর্যটকরা প্রমিত ভাষা সরাসরি বুঝবেন না ঠিকই, কিন্তু একটি মানসম্মত ও ভদ্র উপস্থাপনা, যা প্রমিত রূপে সম্ভব, তাদের কাছে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়।
প্রমিত ভাষার চর্চার বাধা
কক্সবাজারে প্রমিত ভাষার চর্চার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষকদের ভাষা ব্যবহারে প্রমিত রূপের ধারাবাহিকতা সব সময় দেখা যায় না। যখন শিক্ষকই আঞ্চলিক উচ্চারণ বা শব্দ ব্যবহার করেন, তখন শিক্ষার্থীর কাছেও সেটিই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা প্রমিত ভাষা শেখার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না; স্কুল-কলেজে বিতর্ক, বক্তৃতা, আবৃত্তি বা উপস্থাপনার মতো ভাষা চর্চার আয়োজন খুবই সীমিত। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবও এখানে গুরুত্বপূর্ণ; অনেকেই অনলাইনে কথ্যরীতি বা ইংরেজি-বাংলা মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে, যা প্রমিত রূপে অভ্যস্ত হওয়ার পথে বাধা তৈরি করে।
করণীয় কী
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। প্রমিত ভাষাচর্চাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিমালার অংশ করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে তাদের উচ্চারণ, শব্দচয়ন ও ব্যাকরণে দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। শ্রেণিকক্ষে প্রমিত ভাষায় পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদেরও প্রমিত ভাষায় উত্তর দেওয়া, উপস্থাপনা করা ও আলোচনা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি পর্যটন সেক্টরে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য প্রমিত বাংলা ও মৌলিক ইংরেজি প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এতে শুধু সেবার মান বাড়বে না, বরং পর্যটকের সঙ্গে আন্তরিক ও পেশাদার যোগাযোগের পরিবেশ তৈরি হবে।
প্রমিত ভাষা কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক রূপকে অস্বীকার করে না; বরং উভয় রূপই আমাদের ভাষার সম্পদ। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পর্যটনকেন্দ্রিক অঞ্চলে প্রমিত ভাষার চর্চা মানে হলো এমন একটি অভিন্ন মান তৈরি করা, যা দেশের সব জায়গার মানুষ এবং বিদেশিরাও সহজে গ্রহণ করতে পারবেন। কক্সবাজারে যদি এ চর্চা সচেতনভাবে চালু ও বজায় রাখা যায়, তবে এর সুফল কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, বরং অর্থনীতি, পর্যটন ও সামাজিক যোগাযোগেও দৃশ্যমান হবে। এতে করে কক্সবাজার কেবল তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত শৃঙ্খলার জন্যও সুনাম অর্জন করবে।