টেকসই রূপান্তরের ওপর নির্ভর করছে পর্যটনশিল্পের সাফল্য

শেখ মেহেদি হাসান
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:৫১

প্রতীকী ছবি
বিশ্বব্যাপী পর্যটনশিল্প আজ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সংস্কৃতি বিনিময় ও সামাজিক অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং মানুষের জীবনধারার পরিবর্তনের ফলে পর্যটনের ধরন ও পরিসর ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
কক্সবাজারে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, সিলেটের চা-বাগান, রাঙামাটির পাহাড়, লেক ইত্যাদির অনন্য শোভায় পৃথিবীর বুকে অনন্য সুন্দর একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির দেশ-বাংলাদেশেরও রয়েছে বৈশ্বিক পর্যটন বাজারে অপার সম্ভাবনা।
বর্তমান বিশ্বে পর্যটনের মূল চ্যালেঞ্জ হলো টেকসই রূপান্তর। আর এই টেকসই রূপান্তরে পরিবেশ সুরক্ষা, স্থানীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (UNWTO) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মানুষ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটে ভ্রমণ করেছে। ২০২০ সালের করোনো মহামারির প্রকোপে ভ্রমণের এই হার ৭৪ শতাংশ কমে যায়। এর দুই বছর পর, অর্থাৎ ২০২২ সাল থেকে পর্যটনশিল্প আস্তে আস্তে আগের জায়গায় ফিরেছে।
পর্যটনশিল্প বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখে। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করে। কিছু উন্নয়নশীল দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎসই পর্যটন। তবে কিছু সংকট রয়েছে, যা পর্যটনশিল্পে ঝুঁকি তৈরি করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। ফলে উপকূল ও দ্বীপভিত্তিক পর্যটন কিছুটা ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্য দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, অতি পর্যটন (Overtourism) স্থানীয় অবকাঠামো, পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া কভিড-১৯-এর মতো মহামারির ও রাজনৈতিক অস্থিরতা পর্যটনে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুরো শিল্পকেই ধসিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনশিল্প প্রায় ৪.৪ শতাংশ অবদান রাখে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ লক্ষাধিক মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প আজও উল্লেখযোগ্য খাত হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পিত সরকারি উদ্যোগের পরিবর্তে পর্যটন অন্তর্ভুক্ত থাকে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনায়। সম্প্রতি পর্যটন মহাপরিকল্পনা ২০২২-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। যদিও এটা কয়েক দশক আগে প্রণয়ন করার প্রয়োজন ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মহাপরিকল্পনা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম হাতে নেওয়া ও বাস্তবায়ন এখনো প্রত্যাশায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে এক দশকে আন্তর্জাতিক মানের সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন গতি পেয়েছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন বসানো এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা নিঃসন্দেহে দেশের পর্যটনশিল্পের অগ্রগতির কাজটি অনেক সহজ করেছে।
তবে দেশের পর্যটনশিল্পে এখনো পাহাড়সম প্রতিকূলতা ও সমস্যা রয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখনো বহু দেশের নাগরিকদের জন্য ই-ভিসা চালু করতে পারেনি। ব্রাজিলের এক নারী পর্যটক আমাকে বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের ভিসার জন্য ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসে আবেদন করলে দূতাবাস থেকে তাকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ নারীদের জন্য অনিরাপদ।’ এমনকি তাকে ছয় মাস ঘোরানো হয়। ওই নারী ভিসার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে ভিসা পেতে সক্ষম হন। তিনি এরই মধ্যে একাই কয়েকবার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ হোটেল-রিসোর্ট অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির আওতায় আসেনি। দেশের পর্যটনবিষয়ক একমাত্র সরকারি সংস্থা, যেটি হোটেল ব্যবসা করে সেই বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হোটেল-মোটেলগুলোর বুকিং পদ্ধতি এখনো পুরোনো নিয়মে চলছে। তবে আশার কথা এই যে, সম্প্রতি পর্যটন করপোরেশন তাদের সব হোটেল-মোটেলের বুকিং ওটিএতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
পর্যটন প্রচারণার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মেলা ও এক্সপোতে অংশগ্রহণে বাংলাদেশ বরাবরই পিছিয়ে। এর মূল কারণ, বিদেশে পর্যটন প্রচারণায় অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে আগ্রহ কম থাকা। বর্তমানে বিদেশে মেলায় অংশ নেওয়া প্রায় শূন্যের পর্যায়ে নেমে এসেছে। ইউরোপের অনেক মানুষ বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ভ্রমণ করতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এর মূলে রয়েছে প্রচার-প্রচারণার অভাব। বিদেশের মাটিতে পর্যটনবিষয়ক মেলায় অংশ নিলে সেসব দেশের সংবাদমাধ্যমে বেশ ভালো একটি প্রচার পাওয়া যায়। এই প্রচারণাটি দেশের পর্যটনকে পরিচিতি এনে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি বাংলাদেশর পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে বড় অন্তরায়। একজন বিদেশি পর্যটন বিশেষজ্ঞ আমাকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়, রাস্তাঘাট-মাঠ অপরিচ্ছন্ন। উন্মুক্ত ময়লা-আবর্জনা বিদেশিরা খুবই অপছন্দ করেন। অথচ ঢাকার নামিদামি এলাকার ড্রেনগুলোও উন্মুক্ত থাকে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে।
পর্যটনসেবায় দক্ষ জনশক্তির অভাব বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এগিয়ে যাওয়ার পথে আরেকটি বড় অন্তরায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন জাতীয় হোটেল ও পর্যটন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার ৫০ বছর পরও মানসম্পন্ন আরেকটি ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়নি। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রচুর প্রাইভেট ইনস্টিটিউট হলেও সেখানে মানসম্মত প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার তীব্র ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি করে হোটেল ব্যবস্থাপনা অনুষদ খুলেছে, যেখানে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থাই নেই! ফলে প্রচুর তরুণ পর্যটন ও হোটেল ব্যবস্থাপনা শিখলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দক্ষ কর্মীর অভাব থেকেই যাচ্ছে। নিরাপত্তা ও পর্যটকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা আরেকটি বৃহৎ সমস্যা। প্রায়ই পর্যটন এলাকার স্থানীয় লোকজন আগত পর্যটকদের হয়রানি করে। ফলে বিদেশি পর্যটকরা নিরুৎসাহিত হয়। বাংলাদেশে আশানূরূপ বিদেশি পর্যটক না আসার সবচেয়ে বড় কারণ নিরাপত্তাহীনতা। বিদেশি পর্যটকরা যে দেশটি ভ্রমণ করতে চান, সে দেশ কতটা নিরাপদ তা খতিয়ে দেখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশীয় পর্যটকরাই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। সে ক্ষেত্রে বিদেশি পর্যটকরা তো আসার কারণই নেই।
জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (UNWTO) বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য হলো, ‘Tourism and Sustainable Transformation’ অর্থাৎ ‘পর্যটন ও টেকসই রূপান্তর’। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পর্যটনকে উৎসাহিত করতেই এই প্রতিপাদ্য। টেকসই পর্যটন মূলত টেকসই উন্নয়ন হতে এসেছে। টেকসই উন্নয়ন হলো সেই উন্নয়ন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনগুলো মেটানোর ক্ষমতার সঙ্গে আপস না করে বর্তমানের প্রয়োজনগুলো মেটায়। টেকসই পর্যটনে চারটি প্রধান দিক রয়েছে-১. পরিবেশগত, ২. প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও দূষণ হ্রাস, ৩. স্থানীয় জনগণের আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি এবং ৪. স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য টেকসই রূপান্তরের কৌশল হতে পারে, ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন : সুন্দরবন, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবেশবান্ধব পর্যটন অবকাঠামো। স্থানীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন (Community-Based Tourism) : স্থানীয় জনগণকে পর্যটনসেবা ও পণ্য উৎপাদনে যুক্ত করা। ডিজিটাল মার্কেটিং ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং : ‘Virtual Reality Tour’ ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা। পরিবেশ সুরক্ষা নীতি : বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তবে এর সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে টেকসই রূপান্তরের ওপর। আন্তর্জাতিক পর্যটনশিল্পে বর্তমানে যে প্রবণতা ও চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে এমন এক পর্যটন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে যা প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে। টেকসই পর্যটন শুধু পরিবেশ রক্ষার উপায় নয়, বরং এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃজন এবং সাংস্কৃতিক মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম চাবিকাঠি।
লেখক : উপব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা)
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন
Email: skmhasan@gmail.com