
বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় একটি দেশ। বাংলাদেশের রাজনীতি কখনো কখনো প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলে যে এই উত্তাপ বিদেশের মাটিতেও সংঘাতে পরিণত হয়। সেই সংঘাত থেকে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে প্রবাসের মাটিতে বাংলাদেশের মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত করতেও এক শ্রেণির মানুষ দ্বিধা করে না। এর খারাপ প্রভাব পড়ে বিদেশে থাকা প্রত্যেক প্রবাসীর ওপর।
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও সরকারি কর্মকর্তাদের ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশ সফরে গেলে সেখানকার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেমন প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন, তেমনি সরকারপন্থিরাও স্বাগত ও সমর্থনের মহড়ায় ব্যস্ত থাকে। তবে সম্প্রতি এসব কর্মসূচি বেশি সংঘর্ষমুখী ও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি নিউইয়র্কে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনকে নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধঘোষিত সেখানকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যদিও এরই মধ্যে নিউইয়র্ক পুলিশ যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমানকে আটক ও পরে ছেড়েও দেয়।
এর আগে আগস্ট মাসে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিউইয়র্ক সফরকালে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা কনস্যুলেটের সামনে তাকে লাঞ্ছিত করে। বিক্ষোভকারীরা কনস্যুলেট ভবনের প্রধান ফটকের কাচের দরজায় লাথি মারে ও ভাঙচুর করে। এ সময় তারা কনস্যুলেটের পাশের অন্য একটি অফিসের দরজাতেও আঘাত করে। খবর পেয়ে নিউইয়র্ক পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে আসে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস, ১৯৬১ অনুযায়ী, কোনো দেশের দূতাবাসের ওপর হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে ধরা হয়। এই কনভেনশন অনুসারে দূতাবাস, এর কর্মচারী ও সম্পদকে অনাক্রম্য হিসেবে গণ্য করা হয়। ভিয়েনা চুক্তি অনুযায়ী, কোনো দেশের দূতাবাসে শত্রু দ্বারা হামলার ক্ষেত্রে স্বাগতিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ভিয়েনা কনভেনশনের ২২ ধারা অনুযায়ী, যে দেশে দূতাবাস অবস্থিত, সেই দেশ (স্বাগতিক রাষ্ট্র) বিদেশি মিশনের সুরক্ষার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। স্বাগতিক রাষ্ট্রকে অবশ্যই দূতাবাস প্রাঙ্গণে যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ, ক্ষতিসাধন বা শান্তি ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দূতাবাসের সম্পত্তির ওপর কোনো আক্রমণ বা ক্ষতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারেও স্বাগতিক দেশকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হয়। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ দূতাবাসের ওপর হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার দায়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য একাধিকবার লন্ডনে গিয়েছেন। তার এসব সফরের সময়, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রবাসী সমর্থকরা, বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, তার বিরুদ্ধে নানান কুরুচিপূর্ণ ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে থাকা অবস্থায় বিশ্বের যেকোনো দেশে গেলেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ শেখ হাসিনার অপরাধকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য প্রবাসে থাকা সাধারণ বাংলাদেশিরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করলেও সেই বিক্ষোভকারীদের সেখানকার আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এ নিয়েও সাধারণ প্রবাসীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের সংঘর্ষ-সংঘাত হয়েছে। এমনকি সেই সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কারণে অনেক প্রবাসীর বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়-পরিবারকেও নানাভাবে হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। বিদেশে এই ধরনের সংঘর্ষমুখী রাজনীতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল, বিভাজিত ও সহিংসতাপ্রবণ জাতি হিসেবে উপস্থাপন করা। এ ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরে বিক্ষোভ হোস্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে অস্বস্তিতে ফেলে। প্রটোকল অনুযায়ী, নিরাপত্তা দিতে হলেও কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোথায়? এর ফলে বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাণিজ্য ও প্রবাসীদের চাকরির সুযোগে প্রভাব ফেলে।
প্রবাসে বাংলাদেশের প্রায় সব বৃহৎ রাজনৈতিক দলেরই শাখা সংগঠন রয়েছে। এগুলোর কাঠামো মূলত কেন্দ্রীয় কমিটির মতোই : সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ইত্যাদি পদ থাকে। প্রবাসী শাখাগুলো অর্থ সংগ্রহ, সভা-সমাবেশ আয়োজন এবং বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে প্রশ্ন হলো, প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা সংগঠনের কি কোনো আইনগত ভিত্তি আছে? বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন আইনে বিদেশে রাজনৈতিক দলের শাখা খোলার কোনো অনুমোদন নেই। আইনটি শুধু দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে কার্যকর। ফলে বিদেশে চালু হওয়া সব শাখাই মূলত অনানুষ্ঠানিক বা অবৈধ কাঠামোর আওতায় পড়ে। অন্য দেশগুলোতেও এর আইনি ভিত্তি নেই। যেমন-যুক্তরাজ্যের ‘রাজনৈতিক দল, নির্বাচন এবং গণভোট’ অনুযায়ী শুধু স্থানীয় দল নিবন্ধিত হতে পারে। বিদেশি দলের শাখা বৈধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিদেশি প্রতিনিধি নিবন্ধন আইন’ অনুযায়ী বিদেশি দলের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর কানাডায় বিদেশি রাজনৈতিক দলের অফিস আনুষ্ঠানিকভাবে চালানো যায় না। তবে সাংস্কৃতিক বা কমিউনিটি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম কানাডার আইন অনুযায়ী পরিচালনা করতে পারে। এ ছাড়া ইউরোপ, এশিয়াসহ সব দেশেই বাংলাদেশিদের এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আইনগতভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও সব দেশেই বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলগুলো আইনগত সীমারেখা এড়িয়ে শাখা কমিটি পরিচালনা করছে।
এর ফলে বিদেশে সংঘর্ষমুখী বিক্ষোভ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। প্রায়ই তাদের এমন কর্মকাণ্ডের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানিতে নানাভাবে চিন্তাভাবনা করে। এমনকি অনেক দেশ সেখানে থাকা বাংলাদেশি কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠায় এবং অনেক সময় ভিসা বন্ধ করে দেয়, যা দেশের শ্রমবাজার তথা অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে।
প্রবাসে রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও শাখা রাজনীতি বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। তবে এর ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক বিব্রতকর হয় এবং প্রবাসীদের সামাজিক অবস্থান হুমকির মুখে পড়ে। বিদেশে রাজনৈতিক শাখা পরিচালনা আইনসিদ্ধ নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলো কোনো আইন-কানুন তোয়াক্কা না করেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের শাখা সংগঠন ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে বিভেদ ও সংঘাতের জন্ম দিয়ে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তবে বিদেশে সংঘর্ষমুখী বিক্ষোভ ও অবৈধ শাখা রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। প্রবাসীদের উচিত নিজেদের শক্তি ও অবস্থান ব্যবহার করে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা এবং স্থানীয় সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করা।