
প্রতীকী ছবি
একটি জাতির উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। আমাদের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা কতটা, তা বুঝতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র সার্বিকভাবে দেখতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব। দেশের শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করলে প্রত্যাশা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। এ বিষয়ে তাকে কতটা দৌড়-ঝাঁপ করতে হয় সেটা কারো অজানা নয়। অনেক আশা বুকে নিয়ে শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়। খুব সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে সোনার হরিণ এ কারণেই যে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে রয়েছে জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত অবকাশ ও স্বাধীন চিন্তা বিকাশের অফুরন্ত সুযোগ। এতদিন স্কুল-কলেজে তারা যে পরিবেশ পেয়েছে এটা তার থেকে অনেক আলাদা, অনেক ভিন্ন। এখানে রয়েছেন অভিজ্ঞ শিক্ষক, যাদের পাঠদান ও আন্তরিকতায় সমৃদ্ধ হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। পাশাপাশি বিকশিত হবে মনন ও মননশীলতা। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা থাকে খ্যাতিমান ও দেশবরেণ্য শিক্ষকদের ছায়ায় থেকে উচ্চশিক্ষার পাঠ নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়বেন। কিন্তু শিক্ষকদের ভেতরে যে বাণিজ্যিক মানসিকতার উন্মেষ দেখা যাচ্ছে, তা শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে, শিক্ষার্থীদের আশাহত এবং হতাশ করছে। বহির্বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের শিক্ষার মান কতটা নিচে অবস্থান করছে, তা সবারই জানা। এখন প্রশ্ন আসে, শিক্ষার মানের এই সংকট কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাধর্মী পাঠদান বা কারিকুলাম নেই বললেই চলে।
পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন অধ্যাপকের অন্যতম দায়িত্বই হলো কাজের নির্দিষ্ট একটি সময় গবেষণায় ব্যয় করা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন গবেষণা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম নিয়ে ব্যস্ত, তখন আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র দেখলে বিস্মিত হতে হয়। দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ১৬ হাজার ৮০৫ জন। তাদের মধ্যে তিন হাজার ৫৮ জন দুই ধরনের শিক্ষা ছুটিতে আছেন, যা মোট শিক্ষকের ১৮.১৯ শতাংশ। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চাকরিও করেন। কেউ কেউ বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্ট ও বিদেশি সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার সূত্র ধরে এসব তথ্য জানা যাচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পাচ্ছে না। আবার কোথাও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জুনিয়র শিক্ষক কিংবা যা আছে তা দিয়েই চলছে পড়াশোনার পাঠ। এ রকম লম্বা ছুটি এবং প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন কাজে শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়ায় গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান আর গবেষণা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকদের নৈতিকতার বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রবাসে পড়াকালীন বেতন-ভাতা প্রদান অব্যাহত রাখলেও বাস্তব চিত্র খুব ভালো নয়। শিক্ষকদের বড় একটা অংশই বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে সে দেশেই চাকরিতে ঢুকে যান। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পেশ করা ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন হাজার ৫৮ জন শিক্ষক দুই ধরনের ছুটিতে ছিলেন। এ সমীক্ষাটি ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চালানো হয়। এর আগের বছর ছুটিতে ছিলেন দুই হাজার ৬১২ শিক্ষক। অর্থাৎ ছুটিতে যাওয়া শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এত শিক্ষক ছুটিতে থাকলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কাজকর্ম চলে কিভাবে?
দুই.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা অনেক আশা নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর তারা আশাহত হন। কারণ পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, গবেষণা নেই, পাবলিকেশন নেই, সেমিনার সিম্পোজিয়াম কিছুই নেই। পক্ষান্তরে শিক্ষকরা ছুটি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি বা পরামর্শকসহ বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। এ ছাড়া পিএইচডি করতে গিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করা শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করছেন চার হাজার ৩১০ জন। খণ্ডকালীন উল্লিখিত শিক্ষকের বড় একটি অংশ কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে নিজের বিভাগে কোনো রকমে ক্লাস নিয়ে কিংবা ফাঁকি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি, আবাসনের মতো শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন রয়েছে। তবে দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্তত ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুম সংকট রয়েছে। ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ল্যাব নেই, আর ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা নেই। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা আছে মাত্র ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
দেশের উচ্চশিক্ষার দুরবস্থা ও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ গবেষণায় দুরবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে গবেষণার প্রধান অন্তরায় বাজেট সংকট। গবেষণার জন্য যে পরিমাণ অর্থ, সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করা হয় না। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৮৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গবেষণা ক্ষেত্রে তারা যে পরিমাণ বরাদ্দ চান তা পাওয়া যায় না। এমনকি সরকার পরিবর্তনের পরও এ চিত্র বদলায়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মূল সংস্কারের জায়গাটা হওয়া উচিত দুই ধরনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে, সে বিষয়ে জবাবদিহি। এখন আমরা এমন অনেক গ্র্যাজুয়েটকে দেখছি, যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তার শিক্ষা কাজে লাগছে না। বিশ্ববিদ্যালয় যা পড়াচ্ছে, যা গবেষণা করছে তা দেশের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং যেসব গ্র্যাজুয়েটকে তৈরি করছে, তারা দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারছে কি না, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জবাবদিহি থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো রাষ্ট্র ও সরকারের জবাবদিহি। মানসম্মত শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ, দক্ষক্ষ শিক্ষক নিয়োগে রাষ্ট্র ও সরকার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে কিনা, অর্থায়ন করছে কি না, সে বিষয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের জবাবদিহি থাকতে হবে।’
তিন
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) থেকে মোট ১৯ বছরে চাকরি ছেড়েছেন ১৪ শিক্ষক, পাওনা টাকা আড়াই কোটিরও বেশি। এরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে দেশে আর ফেরেননি অথবা ফিরেও চুক্তি অনুযায়ী পূর্ণ সময়ের মধ্যে অধ্যাপনা করেননি। শিক্ষক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের সিলেবাস অসম্পূর্ণ থাকছে এবং পর্যাপ্ত নির্দেশনার অভাব তাদের একাডেমিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পড়াশোনায় তাদের আগ্রহও কমে যাচ্ছে।
বিগত কয়েক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল তার মধ্যে অন্যতম, শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বিবেচনায় নেওয়া। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৬ সালের এক প্রকাশনায় প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ, বিজ্ঞপ্তির বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ, পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত ৩০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির নিয়ম অমান্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগের এই অনিয়মের অভিযোগ অব্যাহত আছে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়া চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত এসব নিয়োগের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও ইউজিসির নির্দেশনা অমান্যের ঘটনা নির্দেশ করে যে, উচ্চশিক্ষা খাতে প্রত্যাশিত কোনো পরিবর্তন এখনো নিশ্চিত হয়নি।
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে যে সংকট তৈরি হয়েছে রাতারাতি এসবের পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের শুরুটা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দুটি বিষয়ে সংস্কার জরুরি। যার একটি হচ্ছে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আরেকটি প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা। শিক্ষক-কর্মকর্তার নিয়োগ-পদোন্নতিসহ বিভিন্ন নীতিগত সংস্কারের ক্ষেত্রে সবার ঐকমত্যে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সবারই উচিত শিক্ষার মানোন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। এতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিও যদি আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে না থাকে, সেটা মোটেও ভালো উদাহরণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদানের উপযোগী করলে শিক্ষার মান বাড়বে, আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে সবার চেষ্টার বিকল্প নেই।