
বৃষ্টি ভেজা দিনগুলোতে শিশুদের কী করে সময় কাটে? ওরা কী নিয়ে খেলা করে? তখন খেতে বেশি মজা লাগে কোন খাবার? ঝমঝম বৃষ্টির দিন ওদের কী করতে, বলতে, ভাবতে, দেখতে ভালো লাগে?
শৈশবে যখন স্কুলে পড়তাম, নানা রকমের ছুটির দিন ছিল। গ্রীষ্মের ছুটি, শীতের ছুটি, পূজার ছুটি, রোজার ছুটি ইত্যাদি। ছুটির একটা তালিকা বছরের শুরুতেই স্কুল কর্তৃপক্ষ দিয়ে দিত, আর ছুটিও শুরু হয়ে যেত রুটিন মেনেই। ছুটি যখন কাছে আসব আসব করত, সে সময় থেকেই আমাদের মনে মনে নানা কিছু ভেবে পৃথিবী ঘোরা হয়ে যেত। কত রকমের আগানবাগান, এদিক-সেদিক নিয়ে ভাবনা চলত! আর সেগুলোর বেশির ভাগেরই খবর আম্মা জানতেন না। ছুটিতে কী করব, সেটার পরিকল্পনা আম্মা করতেন ছুটি শুরু হওয়ার পর!
ছুটি মানে কী? পড়া শেখাকে একেবারেই ছুট দিয়ে দেওয়া? কোনো রকমের পরিকল্পনা না রাখা? এক্কেবারে হা রে রে রে টাইপ ছুটিও কাটানো যায়। কিন্তু সেটা কতদিন? লম্বা ছুটির দিনগুলোতে তাই আমাদের জন্য আঁকা হতো নানা রকমের ব্যস্ত ছক। এর কিছু কিছুর প্রতি ছিল চরম আপত্তি। যেমন-স্কুল না থাকলেও নিয়মিত সন্ধ্যায় পড়তে বসা! আর সবচেয়ে ভালো লাগত ঘুরে বেড়াতে, নতুন কিছু দেখতে, নতুন জায়গায় যেতে।
দীর্ঘ ছুটির মজা হলো কোনো কিছুর আমেজ অনেকটা সময় নিয়ে ধরে থাকা যায়, সুযোগ আছে। কিন্তু এক দিনের ছুটিতে? একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ বা স্বাধীনতা দিবসে পুরো দেশেই নানা রকমের আয়োজন থাকে উদযাপনের জন্য। আমার জানা বা দেখা মতে, অনেক অভিভাবক এমন ছুটির দিনগুলোতে বাইরে বের হন শিশুদের নিয়ে। ফুল কেনা, দিনের সঙ্গে রং মিলিয়ে পোশাক পরা, মাটির তৈরি খেলনা কেনা, হাতে মেহেদির ছাপ দেওয়া, বই কেনাসহ বহু কিছু করার থাকে! খাবারের নানা বিচিত্রও তখন চোখে পড়ে। নানা রকমের আচার, চিংড়ি মাছের মাথা ফ্রাই, বিশেষ করে চটপটি বা ফুচকা থাকে, পাওয়া যায় ঝালমুড়ি, এরপর হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে আইসক্রিম!
সরকারি ছুটির দিন ছাড়া ছুটি পাওয়া যায় সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে। এই দুটি দিন শিশুর কেমন কাটবে সেটা সাধারণত নির্ভর করে শিশুর অভিভাবকের ওপর। যদি দুজনই কর্মজীবী হন তাহলে এক রকম, যদি একজন কর্মজীবী হন তাহলে আর এক রকম। বাবা কৃষিজীবী হলেও মায়েদের আরেক রকম সাংসারিক ব্যস্ততা থাকে। উদ্যোক্তা মায়েদের কাজের ব্যস্ততাও হয় ভিন্ন। কাজেই পুরো দুই দিন না হলে এক কি আধাবেলা শিশুদের নিয়ে বেশির ভাগ অভিভাবক কিছু না কিছু ভাবেন, তবে তার বেশির ভাগই হয় তাদের পছন্দকে কেন্দ্র করে। যেমন-কেনাকাটায় যাওয়া, কিছু খাওয়া বা পার্কে ঘোরা বা পরিচিতজনের বাসায় যাওয়া। আমি ভাবছি নতুন কিছু!
এই যেমন ধরা যাক শিশুকে আর একটু সৃজনশীলভাবে সময় দেওয়া। সেটা হতে পারে কথা, হতে পারে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো, হতে পারে নতুন কোনো খেলনা তৈরি বা নতুন কারো সঙ্গে বা কোনো কিছুর সঙ্গে বন্ডিং! কিন্তু একটা পরিকল্পনা থাকলে শিশুর বয়স অনুযায়ী ডেভেলপমেন্টের জায়গাটা সুন্দরভাবে গ্যাপ না রেখেই এগিয়ে যেতে থাকে! গুছিয়ে পরিকল্পনাগুলো ছুটির দিন কাজে লাগানো সহজ। কারণ এ দিন পরিবারের প্রায় সবাই একটু আরাম আরাম অনুভূতি নিয়ে বাড়িতে থাকে! নির্ধারিত ছুটি ছাড়াও কিন্তু শিশুর জন্য এক একটা দিন হয়ে উঠতে পারে খুব অন্যরকম! যেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়, প্র্রচণ্ড শীত পড়ে বা প্রিয় মানুষ বাড়িতে আসে। প্রাকৃতিকভাবে বা হতে পারে মানুষের কারণে! কারণ যাই হোক, উদযাপন করাই যায়!
সকালে ঘুম থেকে উঠে যেদিন দেখি প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে; চারপাশের দিকে তাকিয়েই মন অন্যরকম হয়ে যায়। বড়রা এমন পরিবেশ নানাভাবেই উদযাপন করে। খিচুড়ি রান্না করার কথা ভাবে, হয়তোবা ভাবে লুচি ও আলুর দম খাব। ভাবে গান শুনব, বই পড়ব, বৃষ্টিতে ভিজব বা আড্ডা দেব! ছোটদের চারপাশে তাকিয়ে ভেতরের অনুভূতি কেমন হয়? এটা ওদের মনকে কীভাবে নাড়া দেয়? তাকিয়ে থাকে কীভাবে?
বৃষ্টি হলে শিশুদের নিয়ে একটা খেলা আমরা নিয়মিত খেলি, বারান্দায় গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে হাত বাইরে বের করে বৃষ্টির ছাট উপভোগ করা! বৃষ্টি টাপুর টুপুর পড়ে আর হাত নেড়ে খেলতে খেলতে ওদের চোখ-মুখ অন্যরকম দীপ্তিতে ভরে যায়!
আর একটা খেলা বৃষ্টির দিনে শিশুরা দারুণ উপভোগ করে; বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে, গান শুনতে শুনতে রং দিয়ে কাগজে খেলা! খুব ভালো হয় ওদের খেলার জন্য জল রং ও তুলি দিলে। খাতা রঙে ভরে যায়, রঙে মেখে যায় ওদের হাত, মাঝে মাঝে জামাও! ওরা যে কি উৎফুল্ল থাকে এই খেলার সময়!
শিশুরা আরো নানাভাবে খেলে বৃষ্টি উদযাপন করতে পারে। খাবার দিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে! যদিও বৃষ্টিতে ভেজার বিষয়টি নির্ভর করবে শিশুর শারীরিক অবস্থার ওপর। ৮ বা ৯ বছর হলে লুডু খেলার মাধ্যমেও চমৎকার সময় কাটাতে পারে। আর একদম কোলের শিশু হলে মা বা বাবার কোলে বসে বৃষ্টি পড়া উপভোগ করতে পারে!
আরো হতে পারে ফুটবল খেলা! এটা একটু বড় শিশুদের জন্য। হতে পারে কাদায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া; যদি শিশুর কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে। অবশ্যই অভিভাবকদের অনুমতি নিয়েই। হতে পারে বৃষ্টির তালে তালে নাচ। ঘুঙুরের শব্দ বৃষ্টির সঙ্গে চমৎকার মানায়। হতে পারে ইউটিউবের সাহায্য নিয়ে অতি বৃষ্টির দুর্দশা সম্পর্কে জানা! হতে পারে বর্ষার গ্রাম বাংলা অথবা শহরের ছবি দেখা বা আঁকার চেষ্টা করা!
মোট কথা, জীবনের ছোট ছোট চমৎকার মুহূর্তগুলো উদযাপন করতে শেখা শৈশব থেকেই! এতে করে শিশুর মধ্যে পরিবেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে চমৎকার ধারণা ও বন্ধন তৈরি হয়। প্রকৃতির স্পর্শ মানুষের মধ্যে বিশালতার অনুভূতি দেয়! পাহাড়, সমুদ্র যেমন বিস্ময়ের তেমনি প্রকৃতির নানা পরিবর্তিত রূপও বিস্ময়ের! এমন বিস্ময়মাখা পরিবেশের মাঝে থেকে পরিবারের মানুষের সঙ্গে আন্দন্দঘন সময় উদযাপন সম্পর্কের গভীরতা তৈরির ক্ষেত্রেও দুর্দান্ত আইডিয়া! কাজেই কেন নয়? শিশু, শৈশব ও প্রকৃতি মিলে হয়ে যাক একাকার এমন বর্ষণমুখর দিনে!
লেখক : শিক্ষা গবেষক ও লেখক