
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এক অদৃশ্য বৈপরীত্য বহুদিন ধরেই গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে। একদিকে সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে নানা পরিকল্পনা ও কর্মসূচির ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে সেই শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রতিদিন নিঃশেষ হচ্ছেন। ইউনেসকোর সর্বশেষ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টের তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষার মূল ভার বহন করছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ, অথচ তাদের জীবনের মান আজ চরম অনিশ্চয়তায়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, দেশে মোট ২১ হাজার ৮৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৯ হাজার ৭৫৭টি বেসরকারি। অর্থাৎ ৯৩.৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই সরকারি নয়। এই প্রতিষ্ঠানে পড়ছে ৯৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৮৭ লাখেরও বেশি, অর্থাৎ ৯৩ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী। জাতির মেরুদণ্ড যে শিক্ষকরা, সেই মেরুদণ্ডের ৯৩ শতাংশই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত!
দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দাবি জানিয়ে আসছেন মূল বেতনের ওপর যৌক্তিক হারে বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, উৎসব ভাতা শতভাগ প্রদান এবং সবচেয়ে বড় দাবি, বেসরকারি শিক্ষার জাতীয়করণ। এই দাবির পেছনে রয়েছে তাদের বাস্তব জীবনযুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ১৩ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সব বেসরকারি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়েছে। কারণ শিক্ষকদের ওপর প্রেস ক্লাবের সামনে পুলিশি হামলা, লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, সবই ছিল তাদের ন্যায্য দাবি দমনের এক নির্মম উদাহরণ। এর আগে সরকার শিক্ষকদের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে সেটি রূপ নেয় মাত্র ৫০০ টাকা বৃদ্ধিতে। এমন হাস্যকর সিদ্ধান্ত শিক্ষক সমাজকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আর্থিক বাস্তবতা অত্যন্ত করুণ। একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক চাকরিতে যোগদানের সময় মূল বেতন পান মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা আর এক হাজার টাকা বিশেষ প্রণোদনা। অবসর ও কল্যাণ তহবিলের নামে মূল বেতনের ১০ শতাংশ কেটে রাখার পর হাতে আসে সর্বোচ্চ ১৩-১৪ হাজার টাকার মতো। একজন কলেজের প্রভাষকের অবস্থাও খুব ভিন্ন নয়, মূল বেতন ২২ হাজার, কিন্তু সব বাদে হাতে পান প্রায় ২২ হাজার ৩০০ টাকা। এই টাকায় একজন শিক্ষক পরিবার চালাবেন কীভাবে?
ঢাকা শহরে এক রুমের ভাড়া ১০-১২ হাজার টাকা, বাজার খরচ, সন্তানের পড়াশোনা-সব মিলিয়ে জীবনযাপন যেন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখানে আরো অন্যায্য বিষয় হলো-ঢাকা, জেলা সদর কিংবা প্রত্যন্ত গ্রাম, সবার জন্য একই বেতন-কাঠামো। অথচ জীবিকার ব্যয় এক জায়গায় অন্য জায়গার তুলনায় বহুগুণ বেশি। তবু বেতনে কোনো ভৌগোলিক পার্থক্য নেই।
অনেকে মনে করেন, শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনি করেই ভালো আয় করেন। বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। গণিত, ইংরেজি বা বিজ্ঞান বিভাগের কিছু শিক্ষক হয়তো প্রাইভেট পড়িয়ে কিছুটা অতিরিক্ত আয় করতে পারেন, কিন্তু ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, বাংলা বা ইসলাম শিক্ষা বিভাগের শিক্ষকদের তেমন সুযোগ নেই। ফলে শিক্ষক সমাজের বড় অংশই দারিদ্র্য ও হতাশার চক্রে আটকে থাকে। তাদের মাসের শেষে হাতে থাকা অল্প কিছু টাকায় সংসার চলে না, চিকিৎসা ব্যয় মেটানো তো দূরের কথা। অথচ রাষ্ট্র এই শিক্ষকদেরই বলছে, তারা জাতির মেরুদণ্ড।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলনের ইতিহাস নতুন নয়। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ২১ দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ১ আগস্ট শুরু হয়েছিল আমরণ অনশন। পরে সরকারের আশ্বাসে অনশন ভাঙা হলেও সেই আশ্বাসের কোনো বাস্তব রূপ দেখা যায়নি। এর পরও শিক্ষকরা থেমে থাকেননি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতীকী অনশন, আগস্টে মহাসমাবেশ ও পদযাত্রা। প্রতিবারই সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু ফলাফল একই, ‘লাঠি-লজেন্স নীতি’। কিছু সময় শান্ত রাখো, তারপর ভুলে যাও। সরকার প্রায়ই বলে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র; তাই তাদের বেতন বৃদ্ধি বা ভাতা নিয়ে সরকারের সরাসরি দায়িত্ব নেই। কিন্তু এই যুক্তি আজ আর টেকে না। কারণ এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগ এখন সরকারের নিবন্ধন ও নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে হয়ে থাকে। রাষ্ট্রই নির্ধারণ করছে কারা শিক্ষক হবেন, কীভাবে নিয়োগ পাবেন, এমনকি কীভাবে বেতন পাবেন। ফলে তাদের অবস্থা নিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অস্বীকার করা এক ধরনের নৈতিক অপরাধ।
বাংলাদেশে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আজ সর্বত্র। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষক সমাজের আর্থিক অনিশ্চয়তা শিক্ষার গুণগত মানে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। একদিকে তারা পেশাগতভাবে নিরাপত্তাহীন, অন্যদিকে জীবনের চাপে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এমন একজন শিক্ষক কীভাবে ছাত্রকে অনুপ্রেরণা, নৈতিকতা বা দেশপ্রেম শেখাবেন? বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন দক্ষ, উদ্ভাবনী ও মানবিক শিক্ষক। অথচ আমরা সেই শিক্ষককেই অবমূল্যায়ন করছি, যার হাতে গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। একই দেশের দুই ধরনের শিক্ষক, সরকারি ও এমপিওভুক্ত, এমন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, যা শিক্ষাক্ষেত্রকে গভীরভাবে বিভক্ত করছে। সরকারি শিক্ষকরা যেখানে বেতন, ভাতা, পদোন্নতি ও অবসর সুবিধা পাচ্ছেন নিয়মিতভাবে, সেখানে এমপিও শিক্ষকরা পাচ্ছেন কেবল অর্ধেক বোনাস আর নির্দিষ্ট পরিমাণ বাড়িভাড়া। বছরে দুইবার ঈদের সময় সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের সমপরিমাণ বোনাস পান, কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন পেয়েছেন মাত্র ২৫ শতাংশ, পরে তা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এ বৈষম্য শুধু আর্থিক নয়, এটি সামাজিক মর্যাদারও প্রশ্ন।
কী হওয়া উচিত এখন? আমরা মনে করি, রাষ্ট্র যদি সত্যিই শিক্ষা খাতকে জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা বন্ধ করতে হবে। ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নই হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ।
১. মূল বেতনের যৌক্তিক হারে বাড়িভাড়া।
২. চিকিৎসা ভাতা বাস্তবসম্মত পরিমাণে বৃদ্ধি।
৩. উৎসব বোনাস শতভাগ প্রদান।
৪. আঞ্চলিক ভৌগোলিক পার্থক্য অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ।
৫. ধাপে ধাপে জাতীয়করণের রূপরেখা প্রণয়ন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকরা ভিক্ষুক নন; তারা জাতির কারিগর। তাদের বেতন বাড়ানো দয়া নয়, বরং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। কারণ একজন সন্তুষ্ট ও মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন এক প্রজন্মের সচেতন নাগরিক। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’-এই কথাটি আমরা মুখে যতই বলি, বাস্তবে তার প্রতিফলন কম। আজকের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সেই মেরুদণ্ডের ভঙ্গুর হাড়সম, যাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রায় পুরো মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা। তাদের প্রতি অবহেলা মানে জাতির ভবিষ্যৎকে অবহেলা করা। যদি সত্যিই আমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তবে শিক্ষককে তার প্রাপ্য মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুবা শিক্ষকদের ক্ষোভ, অবমাননা ও বঞ্চনার এই আগুন একদিন পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দেবে। তখন হয়তো মেরুদণ্ড দাঁড়াবে না, ভেঙে পড়বে চিরতরে।