‘জাতীয় জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরকে বাংলাদেশের নতুন জন্মের সূচনা বলে অভিহিত করছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের প্রচারমাধ্যম ও রাজনৈতিক পরিসরে এই সনদকে বলা হচ্ছে ঐতিহাসিক ‘সমঝোতার দলিল’। সনদে সই করেছে বিএনপি, জামায়াত, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি ফ্যাসিবাদবিরোধী তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এনসিপির বক্তব্য স্পষ্ট-জুলাই সনদে গণ-অভ্যুত্থানের যে জন-আকাক্সক্ষা ছিল, তা প্রতিফলিত হয়নি। তারা মনে করে, জুলাই সনদের প্রধানতম কাজ হওয়া উচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মূল এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এই কারণে এই সনদের সুস্পষ্ট আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি থাকতে হবে। এনসিপি বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ এক বছর ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কাজ করে জুলাই সনদ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রশ্নে একমত হয়েছে। জুলাই সনদ, গণভোট, সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে সক্ষম Constituent Power চড়বিৎ সম্পন্ন আগামী সংসদ (দ্বৈত ভূমিকা)-এই প্রক্রিয়ায় সনদ বাস্তবায়ন হবে। এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, অথচ সনদের অঙ্গীকারনামায় বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ নেই। এনসিপি মনে করে, বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এনসিপির দাবি-জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের টেক্সট এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদে রায় দেয়, তবে নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের রায় অনুযায়ী, আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত ঈড়হংঃরঃঁবহঃ চড়বিৎ বলে সংবিধান সংস্কার করবে এবং নতুন সংবিধানের নাম হবে বাংলাদেশ সংবিধান-২০২৬। এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা ছাড়া সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত হবে বলে এনসিপি মনে করে না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির এ রকম বিশ্বাস হয়তো অমূলক নয়। কেননা গত ৫৪ বছরের রাজনীতি প্রবঞ্চনার। রাজনৈতিক নেতাদের কথা ও কাজের বিস্তর ফারাক এতে। জনগণ বারবার আশ্বাস পেয়েছে, আশ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু আশ্বাসের মূল্য পায়নি। ফলে জনগণকে অনিবার্যভাবে রাজপথে দাঁড়াতে হয়, প্রতিবাদ করতে হয়। বুকের তাজা রক্ত ঝরে, খালি হয় মায়ের কোল। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা বন্দুক তাক করা হয় জনগণের বুকে। ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনা ও তার দলকে গদি ছাড়া করেছে। ফ্যাসিবাদ পতনের পর জনগণ ফের আশায় বুক বেঁধেছে, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে। আকাশচুম্বী জনসমর্থন নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও এক বছরের ব্যবধানে অনেক জায়গাতেই কথা ও কাজের মিল রাখতে পারেনি সরকার। হয়তো সরকারের সদিচ্ছার অভাব কিংবা রাজনৈতিক অসহযোগিতা ছিল তাতে।
দেশ এখন নির্বাচনের ট্রেনে। অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে তার দায় সারতে চাইছে কিংবা সম্মানজনক প্রস্থান নিতে চাইছে।
ফলে জনগণের প্রত্যাশার বারুদ নিভে যাচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার, জনগণের প্রত্যাশা পূরণের চেয়ে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল এখন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। রয়ে যাচ্ছে পুরোনো সংবিধান, যাকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘায়িত হয়েছিল ফ্যাসিস্ট শাসন। সেই পুরোনো সংবিধানের পৃষ্ঠাতেই বসানোর চেষ্টা চলছে জুলাই জাতীয় সনদের দফাগুলো। যেখানে নতুন সংবিধানের দাবি উঠেছে, সেখানে পুরোনো সংবিধানের গায়ে জুলাই সনদের সংযুক্তি মেনে নেওয়া অসম্ভব। এখানেই জুলাই সনদে এনসিপির সই করা না করার যুক্তি। এই সনদে এনসিপি সই করলে তা হতো ফ্যাসিবাদের টেক্সট বুককে মেনে নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা স্বীকার করা, যা করেছে অন্য রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো। এনসিপি এখনো গণপরিষদ, নতুন সংবিধানের দাবিতে অনড়। এ রকম বাস্তবতার মধ্য দিয়েই জুলাই সনদে সই হলো।
জুলাই সনদের সাতটি দফা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো কোনো দফাতে রাজনৈতিক ফাঁকফোকর লুকিয়ে আছে। পুরো সনদটাই এমন এক কাঠামোয় সাজানো যেখানে আইনি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অস্পষ্টতা ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতের ক্ষমতাবানরা তা নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করতে পারে।
প্রথম দফায় বলা হয়েছে ‘রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন করবে কে? স্বাক্ষরকারী দলগুলো কি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখতে পারবে? কে করবে সনদ বাস্তবায়ন সরকার, সংসদ না কি একটি নির্দিষ্ট কমিশন? কোনো কাঠামোগত বা প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনা নেই। ‘পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন’ কথাটি একটি রাজনৈতিক সেøাগানের মতো। যার ভেতরে কোনো গাইড লাইন নেই। রাজনৈতিক বাস্তবতার নকশা নেই। এই অনির্দিষ্টতাই পরবর্তী সময়ে যেকোনো ক্ষমতাসীন পক্ষকে সুযোগ দেবে ‘পূর্ণাঙ্গ’তার সংজ্ঞা নিজের মতো করে নির্ধারণ করতে। বিএনপি তো চাওর করছে, রাষ্ট্রের যে সংস্কার দরকার তা তাদের ৩১ দফাতেই উল্লেখ আছে। সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিএনপির জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে বিএনপি যদি ক্ষমতায় যায়, তার কাছে জুলাই সনদের চেয়ে ৩১ দফার গুরুত্ব অপরিসীম হবে। এই সনদ সংবিধানের পাতায় একটি তফসিল বা সংযুক্তি ছাড়া কোনো বিশেষ অর্থ বহন করবে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, এই সনদ সংবিধানে তফসিলভুক্ত বা উপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে। এখানেই সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি বরাবরই বলছে, বিদ্যমান সংবিধান ফ্যাসিবাদ উৎপাদনের কারখানা। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালে এই সংবিধানই একনায়কতন্ত্রকে আইনি বৈধতা দিয়েছে। সেই সংবিধানকে বহাল রেখে তাতে জুলাই সনদ যোগ করা মানে হলো পুরোনো ফ্রেমে নতুন রং লাগানো কিন্তু কাঠামো একই থেকে যাবে। ফ্যাসিবাদের পিতৃভিটা শেখ মুজিবের হাতে গড়া সংবিধানের সঙ্গে এই সনদকে জুড়ে দিলে তা কখনোই ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতির মূলে আঘাত করতে পারবে না। বরং সেটি হবে ক্ষমতাবাদী রাজনীতিতে নতুন মুখোশে ফিরিয়ে আনার পথ তৈরি করা।
জুলাই সনদের পঞ্চম দফায় যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার ভাষাগত অস্পষ্টতাও কম নয়। বিশেষ করে পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, ‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা হবে।’ শুনতে ভালো লাগলেও এর পরিসর ও প্রয়োগ কৌশল নির্দিষ্ট নয়। কোনো হত্যাকাণ্ড? জুলাইযোদ্ধাদের হত্যাকাণ্ড নাকি অন্য হত্যাকাণ্ড? আওয়ামী লীগ দাবি করছে ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে শত শত নেতাকর্মীকে জুলাই সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। সরকার গণ-অভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতে দায়মুক্ত বলে ঘোষণা করলেও আশঙ্কা করা যায়, কোনো না কোনো দিন জুলাই সনদের এই বিধানের সুযোগ নেবে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ। তারা অনুকূল সুযোগ পেলেই জুলাইযোদ্ধাদের নামে কর্মী হত্যার মামলা ঠুকে দিতে কার্পণ্য দেখাবে না। কোন তদন্ত সংস্থা করবে, কে তদারক করবে, আদালত কিভাবে গঠিত হবে, হত্যাকাণ্ডের বিচার কোন প্রক্রিয়ায় হবে তার কোনো ইঙ্গিত নেই। ফলে ভবিষ্যতে যদি আওয়ামী লীগ বা তাদের মিত্ররা ফিরে আসে, তারা এই ধারার আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পাবে। এটি হবে ফ্যাসিবাদী ন্যায়বিচারের পুনরুজ্জীবন যেখানে বিচার নয়, প্রতিশোধই হবে প্রধান উদ্দেশ্য।
এবার আসা যাক জুলাই সনদের শেষপ্রান্তে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসহ ১২টি কমিশন গঠন করে। জুলাই সনদে উল্লেখ আছে ছয়টি কমিশনের কথা। গণমাধ্যম সংস্কার, নারী সংস্কার, স্বাস্থ্য, শ্রম ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো আলাদা কমিশন পেয়ে থাকলেও জুলাই সনদে যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে-সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ কাঠামো ও দুর্নীতি দমন-সেগুলোতে আধা-সংশোধনের ভাষা বেশি চূড়ান্ত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার বহুমাত্রিক অসংগতির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে অনেক মৌলিক সামাজিক-অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার বিষয়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ গেছে সমাজের নারী বিষয়ক কমিশনের প্রসঙ্গটিও।
জুলাই সনদে যেসব সংস্কার কমিশনের প্রসঙ্গ নেই সেগুলোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি! সময়ের অজুহাতে এসব না থাকার যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাতেই দেখা যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটায় যেন কাঁচি চালানো হয়েছে। গণমাধ্যম, নারী, স্বাস্থ্য ও শ্রম খাত সংস্কারের বিষয়গুলো কেন বাদ গেল সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের সৎ উত্তর মেলেনি। অথচ গণ-অভ্যুত্থানে পোশাক, রিকশা, কল-কারখানার শ্রমিকের ভূমিকাও নেহাত কম ছিল না। আমরা তাদের স্বীকৃতি কিংবা উন্নতির জন্য কোনো বিধান জুলাই সনদে রাখতে পারিনি।
মোট কথা, এসব ফাঁকফোকরই সুযোগ করে দেবে ‘ফ্যাসিবাদের হাওয়া’ বইতে। ফাঁকগুলোই ফ্যাসিবাদের চারাকে ফের মহীরুহে পরিণত করবে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ফের ফ্যাসিবাদের লু হাওয়া পরিণত হবে দ্রুত ঝড়ে। সেই ঝড় হলো পুরোনো অভ্যাস, পুরোনো ক্ষমতাবাদ ও অত্যাচারের পুনরাবির্ভাব। এই ফ্যাসিবাদের হাওয়া ঝড়ে রূপ নিয়ে আঘাত করে জুলাই অভ্যুত্থানের সৈনিকদের। যার একটি কৃত্রিম হাত, পা, চোখ রয়েছে-ফ্যাসিবাদের তাণ্ডব সেগুলোও উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
জুলাই সনদের এই ফাঁকফোকরগুলো শুধু প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, ভবিষ্যতে বিপদের সংকেতবাহী। কারণ ইতিহাস বলে, যতবার ক্ষমতার কাঠামোয় অনিশ্চয়তা বা অস্পষ্টতা থেকে যায়, ততবারই সেই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে একনায়কতন্ত্রের ছায়া। একবার সেই ছায়ার বিস্তার ঘটলে তা কেবল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না; বরং ধীরে ধীরে সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিচার সব ক্ষেত্রকে বন্দি করে ফেলে এক সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণে। ফ্যাসিবাদ কখনো এক দিনে আসে না; তা ধীরে ধীরে আসে নীরব স্বরে, আপসের মধ্য দিয়ে, কাগজের ভাষায়, নীতির ফাঁকে।
যে তরুণরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পথে জীবন দিয়েছে, চোখ, হাত-পা হারিয়েছে তাদের আত্মত্যাগের সম্মান রক্ষার দায় এই সনদের রচয়িতাদের কাঁধেই। কিন্তু যদি অন্তর্বর্তী সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হয়, তবে ইতিহাস আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটাবে ফ্যাসিবাদের। নতুন ফ্যাসিবাদ পুরোনো মুখোশে ফের ফিরবে। জুলাই সনদ আজ এক মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে নবজাগরণের সম্ভাবনা, অন্যদিকে পুনরাবৃত্তির ভয়। যদি সনদের ফাঁকগুলো বন্ধ না করা যায়, আবার রক্ত ঝরবে, আবার খালি হবে শত শত মায়ের কোল। জনগণের করের টাকায় কেনা বন্দুক তাক হবে আমার বুকে। ফাঁসির দড়ি ঝুলবে জুলাইযোদ্ধাদের গলায়। সুতরাং সাবধান হওয়া খুব জরুরি।
