এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিস্তর আলোচনা, বিতর্ক ও আত্মজিজ্ঞাসা। গত দুই দশকের মধ্যে এবারই প্রথম পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে নেমে এলো কেন? প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেননি ৫ লাখেরও বেশি। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও নেমে এসেছে ৬৯ হাজারে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বড় শহরের তুলনায় এবার মফস্বল বা গ্রামের কলেজগুলোর ফলাফল বেশি খারাপ হয়েছে। ইংরেজিতে দুর্বলতা আবারও সামনে এসেছে। শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) জানাচ্ছে, ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশ। তার পর থেকে এই হার আর নিচে নামেনি; বরং বিভিন্ন বছরে ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অটোপাস, গ্রেস নম্বর এবং নমনীয় মূল্যায়নের কারণে ফলাফল ছিল ভালো। ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৫.২৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৫.৯৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮.৬৪ শতাংশ।
আত্মজিজ্ঞাসা
২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৭৭.৭৮ শতাংশ। এবার তা এক ধাক্কায় নেমে এসেছে ৫৮.৮৩ শতাংশে। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি। গত বছর এই সংখ্যাটি ছিল মাত্র ৬৫।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘আমাদের বিবেচনায় উত্তরপত্র মূল্যায়ন যথেষ্ট ভালোভাবে হয়েছে, এবং সেই হিসাবে যথাযথ ফলাফলই আমাদের কাছে এসেছে। আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দিইনি বা নির্দিষ্ট নির্দেশ দিইনি যে, তিনি এভাবে নম্বর দেবেন বা ওভারমার্কিং করবেন।’ তিনি দাবি করছেন, খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ির কারণে যে যত নম্বর পাওয়ার যোগ্য, তাকে তত নম্বরই দেওয়া হয়েছে-এই কারণেই ফলাফল এমন।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এত সরল ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তিনি শহর ও মফস্বলের শিক্ষার মানের পার্থক্য ঘোচাতে না পারা, এমনকি ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবকেও দায়ী করছেন।
তিনি বলেন, ‘কেন খারাপ হলো, তার সুনির্দিষ্ট গবেষণা হয় না, এই কারণেই জানা যায় না। আমরা অনুমানভিত্তিক কথা বলি। এ নিয়ে বিশ্লেষণ দরকার।’ এই শিক্ষক দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষক দক্ষতা, পাঠ্যক্রম ও পাঠদান-সবকিছুতেই মান নিশ্চিত করতে হবে। এমন খারাপ ফলাফলের ধারাবাহিকতা থাকলে শিক্ষার্থীরা ভেঙে পড়তে পারে। তবে শুধু ফল নয়, শিক্ষার মানের দিকেও নজর দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু পরীক্ষাভিত্তিক ও সার্টিফিকেটমুখী না রেখে গুণগত শিক্ষা, দক্ষতা, নৈতিকতা ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য জ্ঞানার্জনের দিকে ধাবিত করতে হবে।’
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আরো বলেন, ‘এই ফলাফল যদি শিক্ষাব্যবস্থাকে আত্মসমালোচনার সুযোগ করে দেয়, তাহলে এই কঠিন ফলাফল হয়তো ভবিষ্যতের জন্য দরকারি একটি পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।’
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানও পরীক্ষার্থীদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ‘তারা সে সময় অনেক মাস ক্লাস পায়নি। আর গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষককে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এ কারণেও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে’, বলেন এই শিক্ষক।
বেশি অকৃতকার্য ইংরেজিতে
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান জানান, এবার সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে ইংরেজি বিষয়ে। বোর্ডভেদে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী পর্যন্ত অকৃতকার্য হয়েছে এই একটি বিষয়ে। সবচেয়ে কম ৫৪.৮২ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে ইংরেজিতে। কিছু বোর্ডে পাসের হার ৫০ শতাংশের সামান্য বেশি।
পাসের হারের দিক দিয়ে মানবিক বিভাগের ফল সবচেয়ে খারাপ।
এই বিভাগে প্রতি দুই জনের একজনই পাস করতে পারেনি। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাসের হার এবার ৫৫.৫২ শতাংশ। সেই তুলনায় বিজ্ঞান বিভাগের চিত্র তুলনামূলক ভালো, পাসের হার ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘মানবিক বিভাগ যারা নেয়, তারা সাধারণত পড়াশোনায় দুর্বল। আর্থিকভাবে সচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা সাধারণত বিজ্ঞান নেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও তাদের বিজ্ঞান নিতে উৎসাহিত করা হয়। যারা পড়াশোনায় দুর্বল, তারা গণিত ও ইংরেজি বিষয়েই বেশি সমস্যায় পড়ে। এ কারণেই মানবিকে পাসের হার কম, আর ইংরেজিতে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বেশি ফেল করেছে বোঝা যাচ্ছে।’
ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি ৭৫.১৬ শতাংশ পাস করেছে বরিশাল বোর্ডে। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৩.৬৬ শতাংশ। রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান তুলনামূলক ভালো হওয়ায় এখানে সামগ্রিক ফলাফলও ভালো। ঢাকা মহানগরে পাসের হার ৮০ শতাংশের বেশি।
আঞ্চলিক বৈষম্য : শহর বনাম মফস্বল
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে পাসের হার ৮৪ শতাংশ হলেও শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে তা ৪২ শতাংশ। ঢাকা বিভাগের অন্য দুই জেলা টাঙ্গাইলে এটি ৪৪ শতাংশ, রাজবাড়ীতে প্রায় ৪৬। মফস্বলের মধ্যে নরসিংদীর অবস্থা তুলনামূলক ভালো, সেখানে পাসের হার ৬৮ শতাংশ।’ এভাবে দেখা গেছে, মফস্বল ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলক বেশি খারাপ করেছে। এটি অবশ্য প্রতি বছরই একই রকম প্রবণতা।
