Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

সংকটে মানুষ, ঝুঁকিতে মধ্যবিত্ত

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১২

সংকটে মানুষ, ঝুঁকিতে মধ্যবিত্ত

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই একটা সংকটের মধ্যে। যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটা জোড়াতালি দিয়ে কোনো মতে চলে যাচ্ছিল। এই কোনো রকমে চলে যাওয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া হতো, কারণ দারিদ্র্য কমাতে দেশ অনেকটাই সফল হয়েছে। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষই হতদরিদ্র ছিল। তখন অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। সার্বিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত সাড়ে ৮২ শতাংশ মানুষ। নব্বইয়ের দশক থেকে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানামুখী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নেওয়ায় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে।

গত ৫ দশকে দেশে দারিদ্র্য হ্রাসে বড় সাফল্য থাকলেও ধনী-গরিবের বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশে এই বৈষম্য দিন দিন বেড়েছে। তবে দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও হঠাৎ ছন্দঃপতন ঘটেছে। কোভিডের পর আবার দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করেছে। তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। করোনার দীর্ঘায়িত প্রভাবে ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। আয় কমে গেছে, জীবিকা হারিয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে দুবেলা খেয়ে-পরে থাকাই কষ্টকর। অন্যদিকে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। প্রণোদনার টাকার সিংহভাগ বড়রাই নিয়ে গেছে। এদের কাছেই ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আটকে থাকার পরও সুবিধা নিতে বা দিতে ভুল করেনি কেউ। বছরের পর বছর নানা ‘ছুতো’য় তারা সময় বাড়িয়েছে। সুদ কমিয়েছে। তারপর প্রণোদনার টাকা নিয়ে দিব্যি আছে। 

করোনাকালে জরুরি পণ্যসেবার ব্যবসায়ও বড়রা উচ্চ মুনাফার লোভ সামলাতে পারেনি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা ভাইরাসের টিকা, হাসপাতাল সেবা কিংবা জরুরি ওষুধপত্র সব ক্ষেত্রেই লাভবান হয়েছে একটি শ্রেণি। পণ্যপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা রুখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় সাধারণ মানুষের করার কিছুই ছিল না। আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। অজস্র পরিবার তখন ঢাকা ছেড়ে গেছে অর্থনৈতিক সংকটে। করোনার পরে মানুষের ধারণা ছিল দ্রব্যমূল্য হয়তো কমবে। কিন্তু কমেনি, বরং তখন যে সিন্ডিকেট করে পণ্যমূল্য বাড়ানো হয়েছে আজও তা অব্যাহত। আওয়ামী লীগের সময়কালে যত মানুষ ধনী হয়েছে, সে পরিসংখ্যান বিস্ময়কর। কিন্তু প্রশ্নটা হলো কেউ ধনী হলে কেউ না কেউ তো গরিব হবেই। তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা ধনী তৈরির কারখানায় পরিণত হওয়ায় গরিবের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে সামাজিক বৈষম্য। করোনার সময়কাল থেকে যত কারখানা, টং দোকান বন্ধ হয়েছে তা আর কখনো খোলেনি। 

করোনার পরই ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পণ্যমূল্য বেড়ে গেল। কারণ জানানো হলো যুদ্ধ। কিন্তু বিশ্বে দাম যখন কমলো, আমাদের দেশে কমলো না। দাম বাড়ার সেই ধারাবাহিকতায় কত পরিবার ছিটকে গেছে তার হিসাব নেই। এককথায় বলা যায়, কোভিডের সময়কাল থেকে দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করে, সেটা আজও থামেনি। 

দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি বর্তমানে সন্তোষজনক সেটা বলা যাবে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধিও থমকে গেছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সতর্ক করে বলেছেন, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যা একটি ছোট অর্থনৈতিক ধাক্কাতেও তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিতে পারে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার গত তিন বছরে ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭.৯৩ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে একজন এখন দরিদ্র। গ্রামে আয় সামান্য বাড়লেও খরচের ৫৫ শতাংশ শুধু খাদ্যেই চলে যাচ্ছে, ফলে সঞ্চয়ের সুযোগ থাকছে না। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ। তবে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে প্রকৃত দরিদ্র, অক্ষম, নারী-শিশু এবং ঝুঁকিতে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এই কর্মসূচিগুলোকে ২০-২৫টিতে একীভূত করলে এর কার্যকারিতা বাড়বে। তাদের মতে, সামাজিক সুরক্ষা কোনো দাতব্য নয়, বরং নাগরিকদের অধিকার। তাই দারিদ্র্য মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী রাজস্বনীতি এবং প্রকৃত দরিদ্রকে চিহ্নিত করার সঠিক ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। 

সম্প্রতি অনেক অনুসন্ধানে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার নানা তথ্য পাওয়া গেছে। শিক্ষিত বেকারত্বের হার বৃদ্ধির ফলে শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের সম্ভাবনা কমেছে। এ ছাড়া গত কয়েকটি শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, অধিকাংশ পেশায় গত কয়েক বছরে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। যেসব পেশায় উচ্চশিক্ষা দরকার সেখানেও কমেছে। সুতরাং দারিদ্র্য হার বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে আয় বাড়েনি। যে কারণে এখন বাজারগুলোতে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কতটা কমেছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এখন মাছের বাজারে চাষের কই, পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া। তাও সব সপ্তাহে সব পরিবার কিনতে পারে এমন নয়। মাছ, সবজির দাম চিন্তার বাইরে চলে গেছে।

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। কিন্তু এই মাছ খাওয়ার সামর্থ্য রাখে কয়জন? তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল কি? দেশে উৎপাদিত পণ্য আমার দেশের মানুষ খেতে পায় না। দাম চড়া। কেন চড়া? কৃষক, জেলে যারা ধান- সবজি ফলান তাদের লাভ হচ্ছে না। লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী। মুদির পণ্যেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। অর্থাৎ এত শহীদের রক্ত, আত্মদানও পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারেনি। ফলে একদিকে কোটিপতি বাড়ছে, আরেকদিকে বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন খাতা-কলমে টিকে আছে।

অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত বলে তাদের ধনী ও দরিদ্রের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে। এদের সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পেশা, আয়, শিক্ষা বা সামাজিক মর্যাদা থাকে, যা তাদের নিম্ন বা উচ্চ শ্রেণি থেকে আলাদা করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সাধারণত এমন পেশায় থাকে যাদের জন্য উচ্চশিক্ষা বা বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়, যেমন : শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা বা ছোট ব্যবসায়ী।  তাদের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলকভাবে ভালো থাকে। এদের জীবনযাত্রার মান এমন হয়, যেখানে মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কিছু বিলাসদ্রব্য বা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার ক্ষমতা থাকে। কিছু গবেষণায় এদের মাসিক আয় চল্লিশ হাজার থেকে এক লাখ ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের আয় এখন  ২০ থেকে ৩০ হাজার, যাতে তার সংসার চলে না। ফলে জীবনযাত্রার মান নেমে যাচ্ছে। মানুষ গরিব হচ্ছে। আবার চাহিদা অনুসারে কর্মসংস্থান হয়নি আজও, বরং কমেছে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সঠিক নীতি ও কার্যকর সমাধান ছাড়া এই ধারা চলতে থাকলে আরো বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামবে। একটি দেশে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে অনেক প্রত্যাশা থাকে, অনেক বদলও হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বৈষম্য বেড়েছে শুধু বাজারব্যবস্থা পরিচালনায় অব্যবস্থার কারণে। সততা ও নিষ্ঠার ঘাটতির কারণে বাজার চড়া, সক্রিয় সিন্ডিকেট। সবখানে মুনাফাখোর, দালাল, মধ্যস্বত্বভোগীদের এই থাবা থেকে দেশকে মুক্ত না করলে, দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে বা বিদেশে শ্রম রপ্তানির বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব না দিলে সামাজিক অস্থিরতা আরো বাড়বে, বাড়বে বৈষম্য দরিদ্রতা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র এ বিষয়টি নিয়ে না ভাবলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫