Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

যেখানে হত্যা হয়, কিন্তু খুনি থাকে না

Icon

জয়নাল আবদীন

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৫

যেখানে হত্যা হয়, কিন্তু খুনি থাকে না

দুনিয়ায় যত ধরনের অপরাধ আছে, এর মধ্যে হত্যা বা খুন হচ্ছে সর্ব নিকৃষ্ট অপরাধ। এই ঘৃণিত অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া এক এক দেশে এক এক রকমের। কোথাও খুনের অপরাধে কতল করা হয়, কোথাও কারা ভোগের সাজা হচ্ছে, কোথাও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। তবে বিচারপ্রক্রিয়া যাই হোক না কেন, হত্যাকারী বা অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শাস্তি ভোগ করে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তারা।

কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে আমাদের দেশ। এখানে হত্যা মামলার বিচার হয়, কিন্তু হত্যাকারী বা খুনির বিচার হয় না। কে খুন করল, সেই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্র বা বিচার বিভাগ কেউ দেয় না। দেশে হত্যা মামলা বিচারের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে যে চিত্র আমরা পাই সেটা শুধু হতাশাজনক নয়, রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের ওপর আমজনতার বিশ্বাসের মাত্রাকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে দেয়।

১৮৬০ সালের দণ্ড বিধিতে ১০টি ধারা রয়েছে। যেসব ধারার অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে খুনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২; সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর অপরাধের বিচারে ফাঁসির শাস্তির বিধান আছে। যে আইনেই হত্যা বা খুনের অপরাধ হোক না কেন, অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তির বিচার না হয়ে আইনের ফাঁকফোকরে, ক্ষমতার দাপটে, মামলার তদন্তে অপরাধীকে শনাক্ত করতে না পারার কারণে, অনেক ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের অদক্ষতা ও রাজনৈতিক কারণে ভুক্তভোগীর বিচার না পেলে একে রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের দায়িত্বহীনতা বলা যায়।

অপরাধীকে শনাক্ত করে বিচারের নিমিত্তে আদালতে সোপর্দ করা রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব। রাষ্ট্র কর্তৃক চিহ্নিত অপরাধীকে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করে তার অপরাধের সাজা নিশ্চিত করা আদালত বা বিচার বিভাগের দায়িত্ব। আমাদের দেশে ৮০ শতাংশ হত্যা মামলার বিচার হয়, কিন্তু হত্যাকারী বা খুনির বিচার হয় না। বিষয়টি পরিষ্কার করি, এভাবে হত্যা মামলার বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে সব আসামি খালাস পেয়ে গেলেন। কিন্তু আসল হত্যাকারী বা খুনিদের বিচার না করে কিছু নির্দোষ মানুষকে লাঞ্ছনা দিয়ে মামলার বিচার সমাপ্ত করাই কি প্রকৃত অপরাধীর বিচার?

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছরে এক হাজার ২৯৮টি খুনের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এসব খুনের মামলায় কোনো ক্লু না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব খুনের দায়ে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। 

একটা খুন হয়েছে, কেউ না কেউ তো এই অপরাধ করেছে! কিন্তু এই অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা বা অপরাধীকে খুঁজে বের করে আইনে সোপর্দ করার কোনো আইনি ব্যবস্থা আছে কি? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কার কাছে চাইব?

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশে চার হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এসব হত্যা মামলার ৫২ শতাংশই প্রমাণ করা যাচ্ছে না। যেসব হত্যা মামলায় আসামিরা খালাস পাচ্ছেন, সেসব হত্যা মামলার ৩৮.২ শতাংশ বাদী ও আসামির আপস হয়। সেই আপসের ধরন এক আজব প্রকৃতির। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দেয়, তিনি বা তারা হত্যাকাণ্ড দেখেননি। বাদী ও আসামি আপস হলে আরো একটি কৌশল নেওয়া হয়। মামলার তদন্তকারী অফিসারকে দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং হত্যাকারীকে আর বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। ১১.৪ শতাংশ মামলায় তদন্তে ত্রুটির কারণে আসামি খালাস পায়। অনেক মামলায় দেখা যায় বিচারিক আদালত মামলার তদন্তের ত্রুটির কারণে আসামিরা খালাস পেয়েছেন মর্মে মন্তব্য করেন। সরকার পক্ষ খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো আপিলও করেন না। বিচারক আদালত তদন্তের কারণে আসামি খালাস পান বলে উল্লেখ করলেও সরকার পক্ষ থেকে এসব মামলা পুনরায় তদন্তে কোনো ব্যবস্থা করা হয় না। 

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব হত্যার ঘটনা ঘটে, এর ৯০ শতাংশই বিচারের আওতায় আসে না। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩২ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। বিচার কয়টির হয়েছে আমরা জানি না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই রকম। 

জানা যায়, গত ২৮ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০টি খুনের একটিরও বিচার হয়নি। ১৯৮৮ সালের তৎকালীন ছাত্রসমাজ নেতা হামিদের হাত কর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় হত্যার রাজনীতি। অতি সম্প্রতি ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, দেশের সর্বোচ্চ আদালত মহামান্য আপিল বিভাগ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সংক্ষিপ্ত রায়ে মামলার সব আসামি আপিলকারী ও আপিল করেনি সব আসামিকেই খালাস ঘোষণা করছেন। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে পুনঃ তদন্তের বিষয়ে নির্দেশনা ছিল। মহামান্য আপিল বিভাগ পুনরায় তদন্তের বিষয়টি বাতিল করেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং শতাধিক আহত হন। অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তৎকালীন সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজান।

২০০৭ সালের এক এগারোর সরকার সিআইডি তদন্ত করে ২২ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অধিকতর তদন্ত করে তারেক রহমানসহ আরো ৩০ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয়। বিচারিক আদালত ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। মহামান্য আপিল বিভাগ সব আসামিকে খালাস দেন ও হাইকোর্টের পুনঃ তদন্তের নির্দেশনা বাতিল করেন। নিশ্চয় আসামিরা নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় খালাস পেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে।

কিন্তু গ্রেনেড হামলা করে কেউ না কেউ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে তো ঘটিয়েছে। রাষ্ট্র দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারে সোপর্দ করতে ব্যর্থ হলেন। সর্বোচ্চ আদালত পুনঃ তদন্ত বাতিল করলেন। হত্যা মামলার বিচার সমাপ্ত হলো, হত্যাকারীর বিচার হলো না। এভাবেই দেশে ৮০ শতাংশ হত্যা মামলার বিচার হয়। হত্যাকারী বা খুনির বিচার হয় না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫