আমাদের শৈশবে কিছু বিষয় ছিল পানির মতো স্বাভাবিক। যেমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য একটা হারমোনিয়াম থাকত, আবার না থাকলেও তারা খেলাঘর বা কচি-কাঁচার মেলা জাতীয় শিশু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি শিখত। শিল্পকলা বা শিশু একাডেমিতেও এসব শেখানো হতো। আর সরকারি স্কুলগুলোতে থাকতেন একজন সংগীত শিক্ষক। সরকারি স্কুলগুলোতে এই ধরনের কারিকুলাম রাখার পেছনে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল! কেননা গ্রীক দার্শনিক প্লেটো তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে শিশুদের জন্য ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শুধু শরীরচর্চা ও সংগীত বাধ্যতামূলক করেছিলেন এ জন্য যে, শরীরচর্চা তাদের দেহকে এমনভাবে গড়ে তুলবে, যাতে তারা বাকি জীবন সুস্থ-সবল থাকবে আর সংগীত তাদের মন ও আত্মাকে উদ্ভাসিত করে জগতের প্রতি, প্রাণের প্রতি তাদের হৃদয়কে সংবেদনশীল করে তুলবে এবং মানুষে মানুষে মানবিক ও সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করবে।
শিশুর মানসিক বিকাশে সংগীতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি ভাষার দক্ষতা বাড়ায়, জ্ঞানের ক্ষমতা (যেমন-পরিকল্পনা ও স্মৃতি), আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক চাপ কমাতে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে এবং সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে। ছোটবেলা থেকেই শিশুকে সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করানো তার সামগ্রিক বিকাশে অত্যন্ত জরুরি, যা তাকে বুদ্ধিমান, সংবেদনশীল ও সুখী হতে সাহায্য করে। গান গাওয়ার মাধ্যমে শিশুরা শব্দ, উচ্চারণ ও বাক্যগঠন দ্রুত শেখে। সংগীতের ছন্দ শিশুদের ধ্বনিভিত্তিক সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা ভাষা শেখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই শিশুদের পাঠ দানের ক্ষেত্রে নার্সারি রাইমসগুলো যখন গানের সুরের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়, তখন সেটা তাদের মধ্যে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। চিত্রকলা ও সংগীত শিশুর প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, এর মাধ্যমে তারা খুব দ্রুত অক্ষরজ্ঞান আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়। কারণ সংগীত মানুষের স্মৃতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের মস্তিষ্কের ‘হিপ্পোক্যামপাস’ এবং ‘ফ্রন্টাল করটেকস’ নামের দুটো বড় অংশ স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতি মুহূর্তেই এরা বিপুল পরিমাণ তথ্য গ্রহণ করে। কিন্তু সেসব তথ্য পুনরুদ্ধার সব সময় সহজ কাজ নয়। তবে সংগীত স্মৃতি-সহায়ক। কেননা সংগীতের ছন্দ-তাল-লয় ও অনুপ্রাস একটা সূত্র মনে করিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করে। বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা গান শোনা শিশুদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সংযোগ বাড়ায় এবং তাদের মনোযোগ, মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বাড়ায়। সংগীত শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ কমাতে এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি শিশুদের মানসিক শান্তি ও আনন্দ দিতে পারে। সংগীতের মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের প্রকাশ করার একটি মাধ্যম খুঁজে পায় এবং তাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়। বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা গাণিতিক শিক্ষার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে।
সাংগীতিক ভাষা এক ধরনের উচ্চতর গণিত। সংগীত না বুঝলে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানকে অনুভব করা অসম্ভব। সাংগীতিক উপলব্ধি ছাড়া ভৌত বিজ্ঞানের চিন্তা অসম্ভব। দর্শনের গভীর অনুভবে পৌঁছাতে সংগীত অপরিহার্য। সাহিত্য হলো সংগীতের সরল অনুষঙ্গ। এমনকি ধর্মকে গভীরভাবে উপলব্ধির সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম সংগীত। তাই অন্যান্য ধর্মে-সংগীত যেখানে প্রার্থনার অনুষঙ্গ, সেগুলো বাদ দিলেও মুসলিম শাসক ও সাধকদের সঙ্গেও সংগীতের বিশেষ একাত্মতা লক্ষ করা যায়। যে কারণে সুফিজম মূলত সংগীতনির্ভর। আল-সামার (গান ও বাজনা) সমর্থনে ইমাম আল-গাজ্জালী যে বই লিখেছিলেন, তার কারণেই সংগীত সুফি সম্প্রদায়ের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে।
যে সময়কালকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ইসলামের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়, সে সময়ে সংগীতের বিশেষ চর্চা পরিলক্ষিত হতো। খলিফা হারুন-আর-রশীদের রাজদরবারে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মতো সংগীত ও গীতিকাব্য উভয়েরই পৃষ্ঠপোষকতা হতো। সেখানে সংগীতজ্ঞদের পাশাপাশি পুরুষ ও মহিলা ক্রীতদাসরা রাজদরবারের সংগীতানুষ্ঠানে অংশ নিত এবং বিস্ময়কর ছোট ছোট কাহিনি শোনাত। এগুলোই পরে ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’-এর পাতায় জায়গা করে নেয়। খলিফা উসমানের (রা.) সময়ে স্বর ও বাদ্যযন্ত্রর মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার ব্যাপারটি আরবদের আয়ত্তে চলে আসে।
এ ছাড়া বহু মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসকও সংগীতজ্ঞ ছিলেন। ইবনে-আবি-উসাইবিয়া উল্লেখ করেছেন, আল-রাজি সংগীতের ওপর একটি বই রচনা করেছেন। বিশিষ্ট বীণাবাদক আল-ফারাবি ছিলেন মধ্যযুগে সংগীততত্ত্বের ওপর সবচেয়ে বড় লেখক। ইউক্লিডের হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু বইয়ের ওপর টীকাসহ তিনটি বই লেখেন তিনি, যেখানে তার মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় ফুটে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে কিতাব আল-মুসীকি আল-কবীর হলো প্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচলিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বই। তার রচিত ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদকৃত ‘ইহসা আল-উলুম’ সংগীত সম্পর্কে বেশ জনপ্রিয় একটি বই। বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত সারমূলক তার এই বই পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার বইগুলো ছাড়াও ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদের বইগুলোও ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল এবং তা পশ্চিম ইউরোপের পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইবনে সিনা তার লেখা ‘আল-শিফা’তে সংগীতসংক্রান্ত আগেকার লেখাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছিলেন।
১৩শ শতাব্দীতে, সাফি আল-দিন আল-উরমাউই (১২১৬-১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) জ্যামিতিক স্বরলিপি ব্যবহার করে ছন্দের জন্য বাদ্যযন্ত্রের স্বরলিপি তৈরি করেন, যা ২০ শতকের শেষের দিকে পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৩ থেকে ২০ শতকের গোড়ার দিকে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অটোমান সংগীত বাইজেন্টাইন, আর্মেনিয়ান, আরবি ও ফার্সি সংগীত দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এখনো আরব বিশ্বের দেশগুলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে নৃত্য ও সংগীতকে টিকিয়ে রেখেছে। আর এদিকে একবিংশ শতকে এক প্রবল প্রতিযোগিতার বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সংগীত উচ্ছেদের দাবি! একজন শিশুর জন্য
মাতৃভাষা, বিজ্ঞানের ভাষা, ধর্মের ভাষা জানা যেমন জরুরি, একই সঙ্গে সংগীতের ভাষা আয়ত্ত করতে না পারলে এই দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে আগামী প্রজন্মকে পশ্চাদপদ ও এক অর্থে নিরক্ষর হয়ে থাকতে হবে।
