Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

মিথ ও মুক্তি

Icon

নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৮

মিথ ও মুক্তি

মিথ এক শক্তিশালী বিশ্বাস, এক অতি কাল্পনিক আশ্রয়। আমরা মিথে বিশ্বাস আর আশ্রয় করে বাঁচি, বাঁচতে চাই। মরণের আগে মিথে বিশ্বাস করেই মরি। অজানা আর অজ্ঞতা থেকে বিশ্বাসের জন্ম, মিথেরও জন্ম। মিথ বাস্তবত থেকে মুক্তি দেয়, অনাকাক্সিক্ষত মানসিক যন্ত্রণার পীড়ন থেকে মুক্তি দেয়। সত্য অন্বেষণ করতে হলে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করবার সাহস থাকতে হয়, মিথকে অস্বীকার করার সাহসও থাকতে হয়, সেটা সাধারণের পক্ষে সম্ভব হয় না। মিথ্যা বা মিথ যাই হোক না কেন, তা ত্যাগ করতে হলে অসাধারণ হতে হয়।

সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষ আমরা, নানা রকম মিথ্যাকে সত্যের মতো বিশ্বাস করি; মিথ মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে উপস্থাপন করে। মিথ্যা ও মিথ সম্মিলিতভাবে আমরা প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আমাদের ভেতর লালন করে আসছি। মিথ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়, আশা জাগায়, নিরাশ করে, ভাগ্য আর নিয়তি মানতে শেখায়। এককথায় ইহকালের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে; ব্যক্তি মিথের বিরুদ্ধে গেলে শাস্তি দেয়, ইহকাল ও পরকালে শাস্তির ভয় দেখায়, একক ব্যক্তি মিথ্যার বিরুদ্ধে গেলে তাকে শেষ করে দেয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যখন মিথ্যার মিথের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তখন মিথ্যা পরাজিত হয়, আবার নতুন মিথ তৈরি হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা মিথের আশ্রয়ে জীবন কাটাই। 

কোনো মিথ সময় ও চিন্তার পরিবর্তন দ্বারা এবং নতুন অভিজ্ঞতায় প্রাকৃত মিথ অকার্যকর হয়ে গেলে নতুন মিথ তৈরি হয়। কেবল কিছু মানুষ নতুন মিথ গ্রহণ করলে অধিকাংশের দ্বারা গৃহীত বা স্বীকৃতি না পেলে সর্বজনীন হয়ে ওঠে না। অধিকাংশ গ্রহণ করলে মিথ প্রতিষ্ঠা পায়। আবার একসময় সেটাও নতুন মিথের আগমন ও প্রতিষ্ঠায় অকার্যকর হয়ে যায়। আমরা কল্পিত বিশ্বাসের আশ্রয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাই। মিথ গণবিশ্বাসে পরিণত হলে সেটা দীর্ঘকাল টিকে থাকে। মিথ মানুষের বিশ্বাস, চিন্তাকে অবলম্বন করে ডালপালা মেলতে থাকে। মিথের বিশ্বাসের সঙ্গে অদৃশ্যমান ভবিষ্যৎ এবং দৃশ্যমান বর্তমানকে জড়িয়ে মানুষ চর্চা ও লালন করে। অনাকাক্সিক্ষত দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা কিংবা আকাক্সিক্ষত প্রত্যাশার ঘটন মিথের বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে। 

মিথের ক্ষমতা সবাই বুঝতে পারে না, বুঝতে না পারলেও অন্ধভাবে বিশ্বাস করে যায়। কেউ কেউ মিথের অন্ধবিশ্বাস আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে ব্যবহার করে। তারা সমাজের মানুষকে পরিচালিত করতে মিথের বিশ্বাসকে কাজে লাগায়। তারা মানবিক কল্যাণ চাইলে মিথের আশ্রয়ে কল্যাণকর জীবনযাপনে সমাজকে উজ্জীবিত করে। আর নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইলে সমাজের মানুষকে চালিত করতে কুটকৌশল অবলম্বন করে, যা সাধারণ মানুষ সাধারণত সহজে বুঝতে পারে না। সাধারণ মানুষ তাদের পূর্বসূরির মতো পরম্পরায় মিথের সাধারণ বিশ্বাস নিয়ে নির্ভেজাল সরল জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কেউ ভিন্ন কথা বলতে চাইলে মিথের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। মিথের বিরুদ্ধে যুক্তি উত্থাপন ও তা প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়। যুক্তি অনুধাবন করতে চায় এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে খুবই স্বল্পসংখ্যক। মিথের ক্ষমতা ও তাতে বিশ্বাস কাজে লাগিয়েই ক্ষমতায় আরোহণ করতে হয়, টিকে থাকতেও হয়। 

বিপ্লব করতে মিথের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস খণ্ডন করতে হয়। এটা করা খুবই কঠিন। অধিকাংশ মানুষ যদি আরো উন্নত জীবন চায়, তারা যদি বিদ্যমান মিথের অসংগতি অনুধাবন করতে পারে, তখন নতুন নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হতে চায়। যতক্ষণ বিদ্যমান মিথের প্রতি বীতশ্রদ্ধ না হয় ততক্ষণ তারা সংগঠিত হতে চায় না। তাই বিপ্লব করতে চাইলে অধিকাংশের পুরোনো মিথের বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে হয়। পৌরাণিক ভেঙে দিয়ে নতুন মিথ অধিকাংশের সামনে হাজির করতে হয়। জ্ঞানী পুরুষ আধ্যাত্মিকতা কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে মিথের শক্তিকে ব্যবহার করে। যদি অধিকাংশ মানুষ নতুন মিথে বিশ্বাস স্থাপন করে তখন তারা সংগঠিত হয়। 

মিথে বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত পরিবর্তন সাধিত হয় না, উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। বিশ্বাস স্থাপন করে সংগঠিত হলে সংঘবদ্ধ হয় এবং কিছু অর্জনে সচেষ্ট হয়। অধিক সংখ্যকের চাওয়ার মধ্যে অর্জন নিহিত এবং এর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের বিকল্প নেই। মিথ মিথ্যা বিশ্বাসকে সত্য বলে গ্রহণ করতে নানা রকম গল্প তৈরি করতে মানুষকে প্রণোদিত করে এবং গল্পের মধ্যে মিথ্যাকে গ্রহণযোগ্য করে বাঁচিয়ে রাখে। মিথ কল্পনা করতে বলে, কল্পিত চরিত্র সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করে। 

মিথ সৃষ্টি করে অসাধারণ মানুষ আর মিথ মেনে চলে এবং লালন করে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের কাছে মিথ পবিত্র, যা অসাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করতে চায় না। প্রচলিত মিথকে যারা অস্বীকার করে, বিশ্বাস করতে চায় না, তারা মিথে বিশ্বাসীদের রোষানলে পড়ে, তাদের জীবন বিপন্ন হয়। মিথ সাধারণ মানুষকে প্রশান্ত রাখে, আবার তাদের সংগঠিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বললে তারা মারমুখী হয়ে কেবল অযৌক্তিক প্রতিরোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে তাই নয়, বরং উন্মত্ত আক্রোশে প্রতিশোধে নেমে পড়ে। যুগ যতই বদল হোক না কেন, মানুষের মিথে বিশ্বাস সামান্যও হ্রাস পায়নি। 

মিথ এক আদি জীবাণুর মতো, যা মানুষের মধ্যে, মানুষের সমাজদেহে জাগ্রত অথবা সুপ্তাবস্থায় থাকে এবং জেগে থাকলেও প্রশান্ত থাকে। উপযুক্ত পরিবেশেই আক্রমণাত্মক হয়, বিশেষ করে মিথে অবিশ্বাস দেখালে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতাধর ব্যক্তির ওপর মিথ ভর করে তাকে দিয়ে সাধারণকে বশ করে। মিথ কখনো কখনো সাধারণের ওপর ভর করে। মিথে বশীভূত জনসাধাণের দ্বারা ক্ষমতারও পালাবদল ঘটে। মিথ পূজারি ব্যক্তি, মিথ বশীভূত সমাজ এবং মিথে মোহাবিষ্ট ক্ষমতাধর ব্যক্তি সাধারণ মানুষকে মিথকবলিত করে শাসন করে। মিথের কবল থেকে মুক্তি ছাড়া সামগ্রিক মানুষের মুক্তি অসম্ভব। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫