Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

হুমকিতে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৪

হুমকিতে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। পশু-পাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত সবকিছুই পরিবেশের উপাদান। এসব উপাদান মানুষসহ অন্যান্য জীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই এসব উপাদানের ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রাকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিবেশের ওপর নির্ভর করেই প্রাণের বিকাশ ঘটে, গড়ে ওঠে প্রাণবৈচিত্র্য। দূষণের মাত্রা প্রকট হওয়ার ফলে ক্রমে মানুষের সঙ্গে পরিবেশের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে প্রাণবৈচিত্র্যের বিকাশের ওপরে। 

মানুষের অসচেতনতা এবং বিরূপ আচরণের কারণেই জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, গ্রিন হাউস এফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণির বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা ১-২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দ্বীপ সমুদ্রের নোনা পানির নিচে ডুবে যাবে। কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে, দেখা দেবে প্রকট খাদ্যসংকট। পলিথিন, প্লাস্টিক ও রং তৈরির কারখানা থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাস বায়ুর ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। ওজোন স্তর ছিদ্র হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে প্রথমে ফাইটোপ্লাংটনসহ বিভিন্ন অণুজীব ও পরে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণিকুলের মারাত্মক  ক্ষতি করে। এতে ক্যানসার ও বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। 

সমগ্র বিশ্বে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শিল্প-কারখানা থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমণের ফলে বাতাসে গ্যাসের মাত্রা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধুলো-বালিসহ ধূমপানের ধোঁয়াও জীবজগতের জন্য ক্ষতিকর। বিষের বাষ্পকুণ্ডলীতে ক্রমেই দূষিত হচ্ছে পৃথিবীর বাতাস। বায়ু দূষণের কারণেই বাড়ছে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসার, স্ট্রোক, হৃদরোগসহ প্রাণঘাতী সব রোগ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রোগীদের ১০ শতাংশ বায়ুদূষণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। সেই সঙ্গে পানিদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত মোট দেশীয় রোগীর ১০ শতাংশ। ধানের জমিতে কীটনাশক ও সার বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়।  বিষ ও সারের মিলিত বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে খাল, বিল ও নদীতে।  যে কারণে হুমকির মুখে রয়েছে নদীর জীববৈচিত্র্য। এই বিষের দূষিত খাদ্য গ্রহণে মানুষের লিভার ও কিডনির দীর্ঘমেয়াদি নানা সমস্যায় আক্রান্তের হার ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। 

অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ বাড়ছে। উজাড় হচ্ছে ফসলের জমি, কাটা পড়ছে বন। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২.৩ মিলিয়ন হেক্টর, যা সমগ্র দেশের মোট ভূমির ১৫.৫ শতাংশ। আর প্রতি বছর এই বনভূমি কমে যাওয়ার পরিমাণ ০.১৮ শতাংশ, যা আমাদের অস্তিত্ব ও পরিবেশের জন্য অশনিসংকেতই বটে। একদিকে বন উজাড়, অন্যদিকে মানুষের সীমাহীন ভোগ-বিলাসিতার কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রা, যা বাড়ায় পৃথিবীর উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় তিন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। এর মধ্যেই মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ০.১ থেকে ০.৩ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে। সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হবে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭.৫ শতাংশ ভূমি। মিঠা পানিতে ক্রমান্বয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে লবণের দোষে দুষ্ট হবে চাষযোগ্য ভূমি। বেড়ে যাবে মশা-মাছির বংশবিস্তার, বাড়বে খরা, অতি বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা প্রভৃতির প্রকোপ। 

বন জঙ্গলে বা সাধারণ ঝোঁপঝাড়ে পরিচিত পশুপাখি এখন আর নেই বললেই চলে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে গৃহায়ন, চিংড়ি চাষের জন্য কৃষিজমির ব্যবহার, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ভূমিক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে জলজ পরিবেশের ওপরে যে ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাতে জীবকুলের জীবনধারণ সেখানেও এক রকম অসম্ভব। আবাসস্থলের ক্ষতিসাধন, পরিবর্তিত আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব, প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব ও চোরা শিকারের কারণেই মূলত প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের যেই ক্ষয়িষ্ণু চিত্র আজ পরিদৃষ্ট তাতে সহজেই অনুমেয়, শতাব্দীকাল পরে পৃথিবী তার আবাসযোগ্যতা হারাবে। সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রণীত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন তফসিলে বাংলাদেশে ৩২ প্রজাতির উভচর, ১৩১ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬২২ প্রকারের পাখি, ৮৩ ধরনের কীট-পতঙ্গ, ১৩৭ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ বিভিন্ন ধরনের এক হাজার ২৩১ প্রজাতির উল্লেখ রয়েছে।  কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে নেকড়ে, মালয়ান ভালুক, বারসিঙ্গা হরিণ, বামন শূকর, ময়ূর, ডোরাকাটা হায়েনাসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া শকুন, দেওহাঁস, নাফতা হাঁস, ঘড়িয়াল, মিঠাপানির কুমির, বনছাগল, ঘুরাল, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণসহ বেশকিছু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির প্রহর গুনছে। বিলুপ্ত বিভিন্ন প্রজাতি আর হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, কিন্তু যেসব প্রাণী এখনো আমাদের দেশে সংখ্যায় নগণ্য হলেও অলুপ্ত, সেসব জীবের জীবনধারণ যাতে কোনোভাবেই সংকটাপন্ন না হয়, সে বিষয়ে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে আমরা এই প্রাকৃতিক সম্পদকে বিনষ্ট করছি, কিন্তু এ থেকে মুক্তির উপায় আমরা বের করছি না, বের করলে এ লক্ষ্যে কাজ করছি না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির যেসব উপায় রয়েছে তার জন্যও যথেষ্ট চেষ্টা নেই। আমাদের জীবন ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশের প্রতি আমাদের আরো সদয় হতে হবে। পরিবেশের কারণেই আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস  নিতে পারি, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি।  সুতরাং পরিবেশ দূষণ বন্ধে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি অতীব জরুরি। এ দূষণ রোধ করতে না পারলে আগামী দিনে বড় ধরনের বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে; এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫