Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ডিজিটাল যুগে তরুণীদের রাজনীতি

Icon

সাবিহা খানম

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৮

ডিজিটাল যুগে তরুণীদের রাজনীতি

আমাদের দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির সরব বিস্তার ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক নারী ও পুরুষ তার মতামত প্রদান করে থাকেন। 

ব্যতিক্রম রাজনীতিতেও নয়। নারী তার মতামত প্রদান করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছে। কিন্তু হোক এটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, নারী কিন্তু এখানেও সেইফ নয়। এখানেও তাকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে ট্রলিং, ভুয়া তথ্য এমনকি চরিত্র হননের মতো নিপীড়নের। 

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বরাবরই কম। বাংলাদেশের ‘Gendered Digital Violence’ অনুযায়ী কোনো নারী রাজনীতি করে মানে তাকে খারাপ আঙ্গিকে প্রতিস্থাপন করা হয়। তার ভয়াবহতা ২০২৫ সালে এসেও খুব যে হ্রাস পেয়েছে তা নয়। রাজনীতিতে যোগ হয়েছে নতুন নারীমুখ, হয়েছে ডাকসু, জাকসুর মতো নির্বাচন, যেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুব নারীরা রাজনৈতিক বিভিন্ন দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি এক নতুন বাংলাদেশে নতুন নারী রাজনীতির পদচিহ্ন। 

উদাহরণস্বরূপ, উমামা ফাতিমা, প্রাপ্তি তাপসী, ফাতেমা তাসনীম জুমা, উম্মে সালমার মতো নারীদের নামগুলোও আমরা নিতে পারি। 

এখন আসি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীর ক্ষমতায়নের দিকে। সাধারণত দৃশ্যমান যে, একজন নারীর বক্তৃতা, লাইভ কিংবা পোস্ট খুব দ্রুত ভাইরাল হয়। এটা তাদের ক্ষমতায়নের একটি দিক। কিন্তু অন্যদিকে যত পাবলিক রিচ, ততই সাইবার বুলিং এবং নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটছে। 

নারী রাজনীতিবিদদের ইনবক্সে অশালীন বার্তা, ফেইক আইডি খুলে মিমস ছড়ানো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত। নারী রাজনীতিবিদদের সামান্য বক্তব্যও বিকৃত করে ট্রল বানানো হয়, আপত্তিকর ছবি ছড়ানো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চরিত্র হননের চেষ্টা-এগুলো যেন মানুষের এক বিনোদনের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তব জীবনে যার কোনো ভিত্তি নেই। 

প্রখ্যাত নারী রাজনীতিবিদ রুমিন ফারহানার কথাই ধরা যাক। সম্প্রতি তিনি কিছু বিকৃত ট্রলের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে অন্যতম ‘ডিপফেক’ ব্যবহার করে তৈরি করা ভিডিও। যেখানে দেখা যাচ্ছিল, রুমিন ফারহানা অশালীনভাবে নাচ করছিলেন, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন ভবনে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করার পর থেকেই শুরু হয় তাকে নিয়ে ডিফেমিং এবং চরিত্র হনন।

এ ছাড়া ২ আগস্ট, ২০২৫ নব্য যুব নারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক একজন মুখপাত্র, ফাতেমা খানম লিজা বলেন, তিনি আর কখনো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চান না। লিজা বলেন, চট্টগ্রামে তিনি যাদের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই আজ নারীদের নিয়ে ন্যারেটিভ বয়ান দিচ্ছে, নারীদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।

নব্য যুব নারী রাজনীতিবিদরা একাধিকবার অভিযোগ করেছেন সাইবার বুলিং এবং হলুদ সাংবাদিকতা নিয়ে, যা তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অন্যতম বাধা। 

বিআইজিডি বা ব্র্যাকের কিছু রিপোর্টে দেখা গেছে, নারীরা অনলাইনে তাদের ‘রাজনৈতিক চিন্তা’ প্রকাশে অনিচ্ছুক। হয়রানি, মানহানির ভয়ে তারা চুপ থাকেন। 

অন্যদিকে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, নারী ব্যবহারকারীদের অনলাইন অভিযোগের ৭০ শতাংশ সাইবার বুলিং সম্পর্কিত। তাহলে অনায়াসেই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি পেরেছি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করতে?

ডিজিটাল প্রযুক্তিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নারী পাচ্ছে ধর্ষণের হুমকি, ব্যভিচারের স্বীকৃতি, যাকে আসলে বলা হয় ‘এবহফবৎবফ উরমরঃধষ ঠরড়ষবহপব’. নারীকে একটি কেন্দ্রে রেখে তাকে যেমন একদিকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে তাকেই আবার ভিকটিম করা হচ্ছে। 

পুরুষ রাজনীতিবিদরা, যুব নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে স্বাগত জানালেও পরিশেষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো নারীর অংশগ্রহণ, প্রভাব, মতামত কখনোই নিতে পারে না। প্রথাগত নারিত্বের খোলস থেকে বের হয়ে যখনই কোনো নারী তার মত প্রকাশ, ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখতে চেয়েছে তখনই সে সমাজ বা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হয়েছে। 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা পেলাম নতুন এক শাসনব্যবস্থা। সম্পূর্ণ এক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন হলেও সেখানে কোনো সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়নি। ডিজিটাল যুগে যুব নারী রাজনীতি যতটা সহজতর হওয়া উচিত ছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যতটুকু না ক্ষমতায়নের মাধ্যম হতে পেরেছে, বরং তার চেয়ে বেশি হয়েছে নারী নিপীড়নের মাধ্যম। 

এ জন্য সমাজের মানুষের উচিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও আমাদের সংস্কৃতির সংস্কার সাধন করা। বর্তমান যুব সমাজকে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। এখন জরুরি হলো ভুক্তভোগী নারীদের জন্য সহজলভ্য উপায়ে আইনগত সহায়তা প্রদান এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট জোরালোভাবে ফরমুলেটেড করা। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি নারী নেতৃত্বকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, আইন এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া যুব নারীরা কখনোই সুরক্ষিতভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। 

তাই সুরক্ষিত আইন, নীতি ও অনলাইন পরিবেশ যথাযথ নিশ্চিত হলেই যুব নারীরা রাজনীতিতে খুলতে পারে নতুন দ্বার, কেবল তবেই হবে দেশ ও দশের উন্নয়ন। 

তাই তো বলা হয় ডিজিটাল যুগে যুব নারীর, রাজনৈতিক প্রসার মানেই সমতা, ন্যায় এবং নেতৃত্বের এক বড় লড়াই; যা পরিবর্তন সাধন করতে পারে গোটা এক সমাজ ও রাষ্ট্রের। রাজনৈতিকভাবে যে সমতার রাষ্ট্র, আমাদের প্রত্যেকের কাম্য।


লেখক : রিসার্চ ফেলো 

সেন্ট্রাল ফর লোকাল গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫