Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

‘ফায়ার সার্ভিস চলছে মান্ধাতা আমলের নিয়মে’

Icon

অনির্বাণ বিশ্বাস

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৯

‘ফায়ার সার্ভিস চলছে মান্ধাতা আমলের নিয়মে’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) আলী আহম্মেদ খান।

মিরপুরের শিয়ালবাড়ীর পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক কারখানা, চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানা এবং সর্বশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে। এ অবস্থায় অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন কতদূর? এসব বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকাল ও দেশকাল নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশকাল নিউজের অনির্বাণ বিশ্বাস...

একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক এই ধারাবাহিক আগুনের প্রবণতাকে কিভাবে দেখছেন ?

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের জনবহুল দেশ। আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, কিন্তু মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন। জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। আমাদের দেশের মানুষের জীবনের যতটুকু মূল্য, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরও একই। কিন্তু আমাদের এই মানসিকতা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে ভবন নির্মাণের সময় তারা বিল্ডিং কোড মেনে চলে। কোনো একটি স্থাপনা নির্মাণের সময় তারা বিল্ডিং কোড, ফায়ার কোড, ইলেকট্রিক্যাল কোড মেনে চলে। উদ্দেশ্য মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কোড মেনে চলার বালাই নেই; ফলে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে এবং একের পর এক মৃত্যু হচ্ছে। বাসাবাড়ি, কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, হাসপাতাল যেকোনো ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরÑবিল্ডিং কোড ফলো না করার মানসিকতা রয়ে গেছে। যদিও ইদানীং গার্মেন্টস সেক্টরে বায়ারসের চাপে কিছুটা কোড ফলো করে, তবে এখানে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই। নিরাপদ নগরীর জন্য মেয়র, প্রশাসন বা রাষ্ট্রীয় যন্ত্র থেকে জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা এবং তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র অকার্যকর হওয়ায় আমাদের এই অবস্থা।

এত প্রযুক্তি, জনবল ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কেন আগুনের ঘটনায় মৃত্যু কমছে না? কোথায় ঘাটতি ?

সঠিক বিল্ডিং কোড মেনে ভবন বানানো হচ্ছে না, স্ট্যান্ডার্ড ইকুইপমেন্ট নেই, ইলেকট্রিক্যাল ফল্ট থাকছে, ওভারলোড হচ্ছে। মৃত্যু কমছে না, কারণ  বাসাবাড়ি বানাচ্ছি; কিন্তু নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগ করছি না। 

শিল্প-কারখানা হচ্ছে, সুন্দর স্পেস বানাচ্ছেন; কিন্তু এক্সিট রুট রাখছেন না। ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে; কিন্তু সিঁড়ি রাখছি একটি। একসময় আগুন ছিল কাঠের আগুন, এখন সব কেমিক্যালের আগুন, পেট্রোকেমিক্যাল। বসার চেয়ার থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির আসবাবপত্রে পেট্রোলিয়াম কেমিক্যাল থাকায় খুবই দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যায় এবং এই আগুনের জন্য যে ধোঁয়া হয়, তাতে মানুষ খুব দ্রুত অজ্ঞান হয়ে যায়। বাসাবাড়িতে ইন্টেরিয়র লাগাচ্ছে, দেখতে সুন্দর; কিন্তু এর কারণে আগুনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এই যে মানুষের অজ্ঞতা, উদাসীনতা এবং মানসম্পন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করা হচ্ছে না, ফলে আগুনের ঘটনায় মানুষের মৃত্যুও বেড়ে যাচ্ছে।

মিরপুর, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও বিমানবন্দরের আগুনের ঘটনার মধ্যে কোনো মিল বা অভিন্ন কারণ দেখছেন কি ?

আগুন বিভিন্নভাবে লাগতে পারে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হতে পারে, ম্যাচ বা সিগারেটের আগুন হতে পারে আবার গ্যাসের লাইন লিকেজ বা কেউ আগুন লাগিয়েও দিতে পারে। আগুনের সাম্প্রতিক এই তিন ঘটনায় তদন্ত করে বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক পালাবদল চলছে, তাতে যেকোনো দুষ্কৃতকারী হোক বা রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেপিআই পয়েন্টে, এয়ারপোর্ট বা ইউপিজেড-সেখানে গোয়েন্দা নজরদারি থাকে। কিন্তু আমাদের যে অবহেলা আছে সেটার সুযোগ অনেকে নিতে পারে। সুতরাং মিল-অমিল বড় কথা নয়, এখন অবশ্যই সবদিক মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। এখন আমরা যদি একটা কথা বলে দেই তাহলে আসল কারণটা বের করতে পারব না।

বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট থাকার পরও আগুন প্রথমেই কেন নেভাতে ব্যর্থ হলো? তাদের কাজে কোনো ঘাটতি দেখছেন কি না ?

যেকোনো আগুন প্রাথমিক পর্যায় থেকে গ্রোথ স্টেজ হয়ে ডেভেলপ স্টেজ হয়ে আস্তে আস্তে কমে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে নিজস্ব লোক দিয়ে। কারণ সব সময় ফায়ার ব্রিগেড এসে আগুন নেভাবে না। প্রথম ১০ মিনিট আপনাকে ফাইট করতে হবে। আমি বলব, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাজে ঘাটতি ছিল, প্রস্তুতি ছিল না। সত্য কথা বলতে, এখানে বিমান কর্তৃপক্ষের পুরোপুরি গাফিলতি আছে। কুইক রেসপন্স করতে পারলে আগুন নেভানো যেত। এখানে মালামাল এমন ঠাসাঠাসি অবস্থায় ছিল যে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে যায়। টেম্পারেচারের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এখানে ডিটেকশন-প্রটেকশন সিস্টেম, কোনো কিছুরই বালাই ছিল না। পরে আগুনের উৎসে আর পানি দিতে পারছিল না। পানি যদি শুরুতেই উৎসে দেওয়া যেত তাহলে আগুন নিভে যেত। আমি বলব, বিমানবন্দরে তাদের কোনো আপৎকালীন পরিকল্পনা নেই, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই এবং অবশ্যই এখানে গোয়েন্দা নজদারির অভাব আছে। বিমান, সিভিল এভিয়েশন, এয়ারফোর্স-এদের মধ্যে আমার মনে হয় কিছুটা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। যার জন্য কেউ কোনো দায়িত্ব নেয়নি এবং দেশের চরম ক্ষতি হয়ে গেল। 

২০০৩ সালের অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন এবং ২০১৪ সালের বিধিমালা-এগুলোর বাস্তবায়ন এখন কোন অবস্থায় আছে ?

বিধিমালা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। কারণ মানুষের জীবনযাত্রা, আগুনের ধরন ও নগরায়ণ-শিল্পায়নের জন্য আগুনের কোডগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোও বিধিমালা পরিবর্তন করে। কিন্তু আমাদের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছাড়াই আইন করার পর এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে বাধা দেয়। বিভিন্ন আইন নিয়ে বৈষম্য আছে। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। শ্রমিকের জীবনের দাম ধরা হয় তিন লাখ টাকা। বিদেশে কিন্তু এটা নেই। একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য এবং একজন শিল্পপতির জীবনের মূল্য একই। বিদেশে একজন শ্রমিক মারা গেলে কোম্পানির পুরো প্রোফাইলসহ শেষ হয়ে যাবে। আমাদের দেশে কঠোর আইন করতে গেলে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ চাপ দেবে। সরকারের চেয়ে তাদের শক্তি বেশি। তারা এসে আইন পরিবর্তন করে ফেলে। তারপর রয়েছে দক্ষ-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের অভাব। আইনের বিধিমালা হালনাগাদ ও বাস্তবায়ন করা উচিত। সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি ইউনিফায়েড ল অ্যান্ড অর্ডার নেই এবং এই সুযোগটা অনেকেই নেয়।

২০১৮ সালে কিছু বিধান স্থগিত করা হয়-এতে কি মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে?

অবশ্যই। যদি আইনে স্পষ্ট কিছু না থাকে এবং বৈষম্য থাকে তখন যারা ভবন ডিজাইন ও পরিকল্পনা করবে এবং যারা আইন বাস্তবায়ন বা বলবৎ করবে তারা একটা বড় গ্যাপের মধ্যে পড়ে যায়। ফলে সুযোগ-সন্ধানীরা সুযোগ নিয়ে থাকে এবং আপনি কাউকে ধরতে পারবেন না। সরকারিভাবে এই সমন্বয় করা দরকার। মন্ত্রণালয়গুলো কোনো দায়িত্ব নেয় না, তাদের জবাবদিহি নেই। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আলাদা ফায়ার কোড আছে; কিন্তু আমাদের নেই। আমাদের দেশে ফায়ার বিধি করছে; কিন্তু আলাদা কোড নেই। যে যেটাই করুক ফায়ার কোড ফলো করতে হবে। ফায়ার কোড থাকলে দেখবেন সব লাইনে চলে আসবে। এই ফায়ার কোড করতে দিচ্ছে না বিভিন্ন আর্কিটেক্ট গ্রুপ।

আপনি যখন দায়িত্বে ছিলেন, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল ?

বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল, বিশেষ করে ফায়ার ব্রিগেডের যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেটা ১৯৮২ সালের আগের। সব দপ্তরের সংস্কার হলেও ফায়ার সার্ভিসে কোনো সংস্কার হয়নি। এটাই প্রধান সমস্যা। দেশে যখন অপরাধ বেড়ে গেল, অপরাধের ধরন বদলালো, তখন নিরাপত্তার জন্য হাইওয়ে পুলিশ, র‌্যাব, নৌ পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, সিটিটিসি, সোয়াট, পিবিআই ইত্যাদি ইউনিট বানানো হলো। কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডে তেমন কিছুই হয়নি, বিশেষ করে রুট লেভেলে। অন্য দেশে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট বলে না, বলে পাবলিক সেফটি ডিপার্টমেন্ট। এখন আগুনের ধরন পাল্টে গেছে, কেমিক্যালের ব্যবহার বেড়েছে। সম্পূর্ণভাবে সংস্কার হয়নি-প্রশাসনিক, নীতিমালা, পরিচালনাসংক্রান্ত, কোনো সংস্কারই হয়নি। পরিচালনা সামর্থ্য বাড়াতে হবে। কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে, ইকোনমিক জোন হচ্ছে, সেখানে বিশেষ ফায়ার ব্রিগেড রাখতে হবে। এভাবে এই ডিপার্টমেন্ট নিয়ে চিন্তা করে না সরকার। ফায়ার ডিপার্টমেন্টে ইঞ্জিনিয়ার নেই, আমার সময় আমিই একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট নেই, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নেই। কখনো কোনো সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। নিজস্ব লোক না থাকলে ডিপার্টমেন্টের উন্নতি হয় না। সরকারিভাবে প্রশাসন থেকে লোক আনে, সেনাবাহিনী থেকে লোক আনে, এটা খুবই ভুল একটা বিষয়। র‌্যাব ব্যর্থ হয়েছে, কারণ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে লোক এসেছে, ফলে তারা র‌্যাবকে নিজের মনে করে না। একটা ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব ক্যাডার থাকতে হবে, তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারের লোকেরা যেখানে গেছে, ওই ডিপার্টমেন্ট শেষ। যেমন-রাজউক শেষ। সেভাবে আমি আসছি দুই বছর, কোনোভাবে থেকে চলে যাব। উচ্চ পর্যায়ে এই অবস্থা হলে নিচের লেভেল ডিমোটিভেটেড হয়ে যায়। সিভিল এভিয়েশনের অবস্থা দেখেন। কেউ এটাকে নিজের মনে করছে না। ওখানে প্রফেশনাল ক্যাপাসিটি বিল্ডআপের লোক নেই।

বড় আগুনের পর তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু প্রতিবেদন প্রকাশ হয় না বা সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না। এর পেছনের কারণ কী ?

যখনই বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রতিবেদন অনেক সময় মন্ত্রণালয়ে আসে। অনেকটা দায়সারাভাবে কাজগুলো দেখা হয়। আমাদের দেশে জবাবদিহি নেই, আবার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মন্ত্রণালয়ে যারা আছে, এদের অদক্ষতা আছে, পেশাদারি নেই। অধিদপ্তর চালাচ্ছেন যিনি তার থেকেও কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে। তাই জবাবদিহিও থাকে না। সুপারিশমালা যেগুলো আসে, মন্ত্রণালয় মনে করে তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে এবং এগুলো আস্তে আস্তে ফাইল চাপা পড়ে যায়। দিনের পর দিন ফাইল চাপা পড়ে ইস্যু হারিয়ে যায়। দায়সারাভাবে কাজ চলে এবং জবাবদিহির পুরোপুরি অভাব রয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না কেন? এই দায় কার ?

ঢাকার কথা যদি বলি, এখানে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস আছে। তবে ফায়ার ব্রিগেডের অথরিটি পাওয়ার নেই ভবন বন্ধ করে দেওয়ার। অন্য দেশে কিন্তু ফায়ার ডিপার্টমেন্ট যদি মনে করে এই মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ তারা বন্ধ করে দিতে পারে। তাদের অথরিটি পাওয়ার দেওয়া আছে। যেহেতু ফায়ার সার্ভিসের অথরিটি পাওয়ার নেই, সেহেতু রাজউক, সিটি করপোরেশন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ফায়ার ডিপার্টমেন্টসহ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এখানে মেয়র একটা লিডিং রোল নিতে পারেন।

রাজধানীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার সক্ষমতা কি যথেষ্ট ?

উন্নত দেশগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার জন্য আলাদা রাস্তা থাকে। বিশেষ করে পানির গাড়ি নেওয়ার জন্য। এ ছাড়া সবখানে তাদের ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকে। আমাদের দেশে নেই এবং সমস্যা এখানেই হয়। ঘনবসতি এলাকায় এমনও জায়গা আছে, যেখানে গাড়ি যেতে পারবে না। অবশ্যই এটা অনিরাপদ শহর। এর দায়ভার সিটি করপোরেশন ও রাজউকের। ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিসের থেকে অনুমতি নেওয়া হয় না। কারণ তারা জানে, অনুমতি পাবে না। এ জন্য ফায়ার ব্রিগেডকে বাদ দিয়ে ভবন নির্মাণ করে। আবার ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার রাস্তা না থাকলে তারা কিভাবে সক্ষমতা দেখাবে।

পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও জনবল ঘাটতি নিয়ে এখনো অনেক অভিযোগ আছে-আপনি একমত ?

অবশ্যই। যেটা প্রথমে বলছিলাম, ফায়ার ব্রিগেড সেই মান্ধাতা আমলের ধারায় চলছে। স্টেশনের সংখ্যা বাড়ছে, ছোট ছোট স্টেশন হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান ঝুঁকি হচ্ছে এলপিজি, কেমিক্যাল। এগুলোর কারণে আগুন খুব দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে। মার্কেট বানাচ্ছে, মার্কেটে আগুনের ম্যাটেরিয়েল; ভবন দিন দিন বড় হচ্ছে, সেই তুলনায় ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়েনি। পুলিশের মতো ফায়ার সার্ভিসে কোনো বিশেষ ইউনিট করা হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য স্পেশাল ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ ইউনিট করা প্রয়োজন। হাইরেজ বিল্ডিং, কেমিক্যাল ফায়ার, বেজমেন্ট  ফায়ারসহ বড় আগুনে ফাইট করবে তারা। টপ সদস্যদের নিয়ে এই ইউনিট করতে পারে। খুবই দুঃখের বিষয়, ফায়ার ব্রিগেডের ভালো কোনো প্রশিক্ষণ একাডেমি নেই। প্রশিক্ষণ ও জনবলের ঘাটতি অবশ্যই আছে। আলাদা প্রশিক্ষণ একাডেমি করা উচিত।

ফায়ার সার্ভিসকে যদি এনফোর্সমেন্ট পাওয়ার দেওয়া হয়, তাহলে কি পরিবর্তন আসবে ?

অবশ্যই। যদি আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয় তখন ভয় পাবে। ভাববে, নিয়ম না মানলে ফায়ার সার্ভিস এসে মার্কেট বন্ধ করে দিতে পারে। তাই ফায়ার সার্ভিসকে ‘এনফোর্সমেন্ট পাওয়ার’ দেওয়া হলে কিছুটা হলেও উন্নতি হবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় ফায়ার সার্ভিস শুধু মামলা করতে পারে। মামলাও দীর্ঘদিন ধরে চলে। কে ফলোআপ করবে? তাদের লিগ্যাল উইং নেই। পুলিশে লিগাল উইং ফাইট করে। ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টরকে গাড়ি ভাড়া দিয়ে গিয়ে মামলা চালাতে হয়। নানা সীমাবদ্ধতা আছে। ফায়ার সার্ভিসের সংস্কার খুবই জরুরি।

বাংলাদেশে একটি স্বাধীন ‘ন্যাশনাল ফায়ার সেফটি অথরিটি’ গঠন করা উচিত কি না ?

আলাদা অথরিটি করলে হবে কি, কেউই তখন দায়িত্ব নেবে না। অ্যাডমিন ক্যাডারের লোক নিয়ে আসবে, তখন ফায়ার ডিপার্টমেন্ট দায় নেবে না। যার কাজ তাকেই করতে হবে। ফায়ার কোড ডেভেলপ করে ফায়ার সার্ভিস ইউনিট করতে হবে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সেখানেও আলাদা কোনো ন্যাশনাল ফায়ার অথরিটি নেই। তাদের আছে পাবলিক সেফটি ডিপার্টমেন্ট। এটাকেই তারা সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের ফায়ার বিভাগকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিতে হবে। আলাদা করে কোনো অথরিটি বানালে তখন কেউ দায়িত্ব নেবে না। ‘ন্যাশনাল ফায়ার সেফটি অথরিটি’-এর বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ দ্বিমত। তখন কর্তৃপক্ষের ওপর দায় চাপাবে ফায়ার সার্ভিস। 

ফায়ার সার্ভিসের কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন ?

ফায়ার সার্ভিসের সম্পূর্ণরূপে সংস্কার প্রয়োজন। প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে জনবল বাড়াতে হবে। নগরায়ণ হচ্ছে এবং উপজেলা পর্যায়েও বড় স্থাপনা হচ্ছে, কারখানা হচ্ছে। কিন্তু এখনো সব কিছু সদর দপ্তরভিত্তিক। এগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক কর্তৃপক্ষ থাকবে। আমরা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবি, কোনো দেশকে অনুসরণ করি না। মালয়েশিয়ার একটি ফায়ার সেফটি মডেল আছে, সেটি অনুসরণ করতে পারি। নতুন আবিষ্কার করার কিছু নেই। এখানে প্রশাসনিক সংস্কার দরকার, বিকেন্দ্রীকরণ, পরিচালনাসংক্রান্ত সামর্থ্য বাড়াতে হবে, আধুনিক যন্ত্রপাতি আনতে হবে, আধুনিক ফায়ার কোড করতে হবে, ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে অন্যান্য দপ্তরের আইনের সমন্বয় করতে হবে, কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে, লিগ্যাল উইং রাখতে হবে, এনফোর্সমেন্ট উইং থাকতে হবে, শিল্প নগরের জন্য বিশেষ ইউনিট থাকতে হবে, দেশে-বিদেশে প্রচুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে-এককথায় ব্যাপক সংস্কার দরকার আছে। 

এখন আবার যদি ডিজির দায়িত্বে ফিরে যেতেন, আগুন প্রতিরোধে প্রথম তিনটি পদক্ষেপ কী হতো ?

প্রথমত বললেও আমি আর ফিরে যাব না। তবে পদক্ষেপ হলো, সংস্কারের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। ফায়ার ব্রিগেডের সংস্কার ছাড়া কাজ করা কঠিন। প্রথম যেটা প্রয়োজন, এখানে ফায়ার অথরিটি থাকতে হবে। ফায়ার ফাইটিং ইজ এ লাস্ট রিজন, আমি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় বেশি জোর দিতাম। সেই অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং টিম থাকতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দিতে হবে। ফায়ার কোড ঠিক করতে হবে এবং এটাই প্রধান প্রাধান্য পাওয়া উচিত। জনবল ও মডার্ন ইকুইপমেন্ট বাড়াতে হবে। যেহেতু শিল্প-কারখানা বেড়ে যাচ্ছে, তাই ফায়ার ফাইটিংয়ে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম বাড়াতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫