Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি কি নতুন কোনো আঞ্চলিক সংকেত?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৭

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি কি নতুন কোনো আঞ্চলিক সংকেত?

প্রতিবেশী দেশগুলোকে ‘অধীনস্ত’ মনে করা ভারতীয় শাসকদের একটা পুরোনো অসুখ। তাতে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি বা কংগ্রেসই থাকুক। বিশেষ করে বাংলাদেশকে তারা ‘ছোট ভাই’ বা ‘গরিব আত্মীয়’ হিসেবে করুণা করার মানসিকতা পোষণ করে-এই অভিযোগ বেশ পুরোনো।

সীমান্ত, আন্ত নদী ও বাণিজ্য ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে একটা অসম অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেটি তীব্র হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে। সম্ভবত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তলানিতে।

ভারত তার আরেক প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে এই খবরদারিটা দেখাতে পারে না বলে তার সঙ্গে সম্পর্ক বৈরী। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রেখে ভারতের নিজের কী লাভ সেটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতি জিইয়ে রেখে পাকিস্তানেরও যে খুব বেশি লাভ হয়, সেটিও বলার সুযোগ নেই।

এই যখন পরিস্থিতি তখন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে জনপরিসরে কৌতূহল বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, এটি এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন কোনো সংকেত কি না? 

ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন বলছে, আগামী ১০ বছরে প্রতিরক্ষা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে একটি রূপরেখা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। ৩১ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এই তথ্য জানান। হেগসেথ লিখেছেন, এ চুক্তি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিরোধমূলক সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এটি দুই দেশের মধ্যে সমন্বয়, তথ্য ভাগাভাগি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা আরো জোরদার করবে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে এক বৈঠকের পর হেগসেথ এ ঘোষণা দেন।

এ বিষয়ে রাজনাথ সিং জানান, ফ্রেমওয়ার্ক ফর দ্য ইউএস-ইন্ডিয়া মেজর ডিফেন্স পার্টনারশিপ নামে ১০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান দৃঢ় সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করবে বলেও মনে করেন মি. সিং।

কেউ কেউ মনে করেন, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মূলত মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিশ্চিত করা এবং সন্ত্রাসবাদ ও প্রক্সি যুদ্ধনির্ভর পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ভারত ও বাংলাদেশের সহায়তায় এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব সীমিত করাও হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস পল কাপুর একজন ভারতীয় আমেরিকান। সুতরাং এই চুক্তির পেছনে তার ভূমিকা থাকা অসম্ভব নয় এবং এই চুক্তির আলোকে তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আধিপত্য মোকাবিলায় ভারতকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবেন বলেই মনে করা হয়। যদিও পাকিস্তানের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উষ্ণ। সে ক্ষেত্রে দুই শত্রুরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কি কৌশলে খেলবে, তা এখনই বলা কঠিন। তবে পল কাপুর পাকিস্তানের কড়া সমালোচক হওয়ায় ভারত যে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে, সেটি আন্দাজ করাই যায়।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কাপুরের এই নীতি কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে তার বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ হিসেবে দেখতে চাইবে? যদি তাই হয় তাহলে সেখানে কি তারা ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকেই গুরুত্ব দেবে?

আরেকটি আলাপ এ রকম যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র মূলত চাপের মধ্যে আছে। ট্রাম্প নিজেও তার দেশের ভেতরে শুরু থেকেই বিক্ষোভের সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও চাপের মধ্যে আছে। ফলে চীনকে চাপে রাখতেই হয়তো ভারতের সঙ্গে তার এই প্রতিরক্ষা চুক্তি।

হেগসেথ লিখেছেন, এই চুক্তি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখবে। একই সঙ্গে তিনি বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান অঞ্চলে চীনের তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অর্থাৎ ‘শক্তির ভারসাম্য’ এবং ‘চীনের তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ’-এই দুটি বিষয়ের বিটুইন দ্য লাইন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার একটি বড় বিষয় ছিল সামরিক খাত। ট্রাম্প তখন বলেছিলেন, ভারতের কাছে তিনি সামরিক  সরঞ্জাম বিক্রির পরিমাণ অনেক বিলিয়ন ডলার বাড়াতে চান। তারই অংশ হিসেবে এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধ বিমান পেয়েছে দিল্লি। তবে এরপর রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় কেনা তেলের ওপরে দিল্লির নির্ভরশীলতা আর মস্কোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সামরিক সম্পর্ক ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে বিরক্তির কারণ ঘটিয়েছে বলেও মনে করা হয়। সেই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি নিশ্চয়ই একটা নতুন ডাইমেনশন তৈরি করল।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের এই প্রতিরক্ষা চুক্তি যৌথ সামরিক অভিযান, গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য একটি বিস্তৃত কর্মসূচির দরজা উন্মুক্ত করল। বিশেষ করে যৌথ সামরিক সমন্বয় ও রিয়েল-টাইম গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ড্রোন, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে যৌথ গবেষণা ও উৎপাদন এর অন্যতম। এর মধ্য দিয়ে একদিকে ভারত যেমন নিজের সামরিক সক্ষমতা বাড়াবে। তেমনি ভারত হবে আমেরিকার অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি বিক্রির বিরাট বাজার। অর্থাৎ লাভটা উভয়ের।

ভারতের লাভটা সম্ভবত আরো বেশি এই অর্থে যে, আমেরিকার সঙ্গে তার প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বভাবতই তার প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানকে চাপে রাখবে। পাকিস্তান যেহেতু আমেরিকার কথার বাইরে খুব বেশি যেতে পারে না, সুতরাং ভবিষ্যতে যেকোনো বড় ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান বোঝাপড়া করতে গেলে আমেরিকা সেখানে একটা দেওয়াল হয়ে উঠাতে পারে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক কূটনীতি ও রাজনীতিতে আমেরিকা যদি ভারতের সহায়তা ও সমর্থন চায়, সে ক্ষেত্রে ভূ-রাজনীতির অনেক সরল অঙ্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও এখন বেশ ঘোলাটে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ভারতের আরেক প্রতিবেশী নেপালেও একটা অভাবনীয় অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হয়েছে, যার পেছনে ছিল ‘জেন-জি’দের বিরাট অংশ। এর অব্যবহিত পরেই ভারতের লাদাখে ‘জেন-জি’ বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। যদিও সেটি খুব একটা হালে পানি পায়নি।

বাংলাদেশ ও নেপালে অভ্যুত্থানের পরে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছিল, ভারতের আসাম, মণিপুরসহ বিভিন্ন রাজ্যে যেহেতু বহু বছর ধরেই অসন্তোষ বিরাজ করছে, ফলে বাংলাদেশ ও নেপালের ঢেউ এসব রাজ্যেও লাগবে কি না এবং ধীরে ধীরে পুরো ভারতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে কি না? প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এসব বিক্ষোভ ও অভ্যুত্থান নিয়ে ভারত সরকার যে চিন্তিত নয়, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অতএব এ রকম একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রতিরক্ষা চুক্তি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আবার শুধু অভ্যন্তরীণ ক্যাচাল প্রশমনের জন্যই যে ভারত এই চুক্তি করে, সেটি ভাবার কারণ নেই। কারণ ভারত শুধু এই অঞ্চলের নয়, বরং পুরো পৃথিবীরই অন্যতম পাওয়ার হাউস হতে চায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫