জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিপুল জনসমর্থন পেয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। এই সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এই সরকারের সময়ে জুলাই গণহত্যার বিচারপ্রক্রিয়া কাক্সিক্ষত মাত্রায় অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। হাতে গোনা কয়েকটি মামলার চার্জশিট হয়েছে, বাকি মামলা তদন্তের টেবিলে। রাষ্ট্র সংস্কারের যে ইস্যু ছিল তা কেবল জুলাই সনদের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে; দেশ এখন নির্বাচনের ট্রেনে।
ভোট কীভাবে হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ হবে কি হবে না? এসব প্রশ্নের বোঝা মাথায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ট্রেনে উঠে পড়েছে। জোট গঠন, আসন ভাগাভাগি, রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে দলগুলো নিজেদের আচরণ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এসব আচরণ ক্ষমতার ভাগাভাগিকেন্দ্রিক। অথচ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল রাষ্ট্র গঠনের একটি অনিবার্য সুযোগ। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেøাগান তুলে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, সেই চেতনা থেকে আমরা অনেক দূরে। এক বছরের মাথায় যেন ভুলতে শুরু করেছি সব। জুলাইযোদ্ধারা এখনো রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কেউ হাঁটছেন ক্র্যাচে ভর করে, কারো চোখ নেই, কর্মসংস্থান নেই, জীবিকা নেই। প্রতিদিনকার এসব দৃশ্য হতাশাজনক।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠন করলেও তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে। ফাউন্ডেশনে তহবিল সংকট, অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। এমনকি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে একজন জুলাইযোদ্ধাকে নির্যাতন করার অভিযোগে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন জুলাইয়ের চেতনা ছড়িয়ে দিতে যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল তা রাখতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই স্মৃতির কথা মুখে মুখে বললেও বাস্তবতার সঙ্গে তাদের যেন কোনো সম্পর্ক নেই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) যেন হতাশা তৈরি করেছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর ভেতর দিয়ে বিকশিত হয়েছে। এই কারণে জাতীয় নাগরিক পার্টি আমাদের মতো তরুণদের মনে কিছুটা হলেও স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিল কিংবা আশাবাদ জাগাতে পেরেছিল।
কিন্তু দিন শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টিও আমাদের মনে হতাশার জাল বুনে দিয়েছে। মধ্যমপন্থি এই দলটি সেই পুরোনো ধাঁচে চলতে শুরু করেছে, নতুনত্ব নেই। নেতাদের ব্যানার-ফেস্টুনের ছড়াছড়ি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে হোন্ডা কালচার, শোডাউন, কমিটি গঠন! এসব ব্যস্ততার মধ্যে এনসিপি গত এক বছর সময় কাটিয়েছে। এই দলটি এখন নির্বাচনের ট্রেনে। অথচ এনসিপি চাইলে গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক পোস্টার প্রতিযোগিতা, জাতীয় রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গবেষণা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভেতর আরো জায়গা করে নিতে পারত। এই প্রশ্নটি জরুরি, এনসিপির ভেতর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জায়গা কতটুকু? আমাদের তো দায়িত্ব ছিল, অতীত গণ-আন্দোলন কিংবা অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ২০২৪ সালে সংগঠিত ছাত্র-জনতার মহান জাগরণ, আত্মত্যাগ কিংবা সাফল্যকে চিরভাস্বর করে রাখা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হতে পারত। এই সত্যটি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনীতি সচেতন জনগণ অস্বীকার করতে পারবে না।
এক দিনে নির্বাচনের ট্রেন, অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। চাওয়ার বিপরীতে পাওনার হিসাবটি বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। সবখানে ক্ষমতা ভাগাভাগির কারবার, কিন্তু জুলাই কোথায়? এখনো ঘুষ, দুর্নীতি, দখল, চাঁদাবাজি ও মহামারি। এখনো ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না, টাকা ছড়ালে যে কারো বিরুদ্ধে চাইলে মিথ্যা মামলা করা যায়, হয়রানি করা যায়! ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জাতিগত আচরণকে আমূলে পরিবর্তন করতে পারত। সেটি কেন হলো না, সেই আত্মজিজ্ঞাসা আমাদের দরকার। কেন এমনটি হচ্ছে? যা হওয়ার কথা ছিল না। এই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। জুলাই-আগস্টের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল? এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণ ক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা নিভুপ্রায়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে আমরা সত্যিকার কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। ফলে হিসাবের খাতায় অপ্রাপ্তির পরিমাণ বেশ।
পুরোনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের এবং সরকারেরও অন্যতম প্রধান শরিক-এই বিপ্লবী আকাক্সক্ষার ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগেরই মনোভাব নেতিবাচক, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাক্সক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান-এই তিনের টানাপোড়েন শেষমেশ জাতীয় আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের বেলায় গোলকধাঁধা তৈরি করেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের আগে থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার, সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে। কিন্তু সংস্কার বন্দি হয়ে পড়ল দুই-তিন পৃষ্ঠার জুলাই সনদের মধ্যে। এ ছাড়া সংস্কার আর নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, সংস্কারের এজেন্ডাটিকে আরো জটিল করে তোলা হলো। কিন্তু জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনে সম্ভাবনার পথ এনে দিয়েছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে?
রাজনীতির কোথাও কোথাও, নীতিনির্ধারণের কোথাও কোথাও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রতি সফট কর্নার তৈরি হয়েছে। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসররা। আমরা কি ধরে নেব আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাক্সিক্ষত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। আমাদের আত্মসমালোচনা দরকার, বোধোদয় দরকার। গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন না করে শুধু ক্ষমতার লোভে কোনোভাবেই আপস করা যাবে না। আমাদের সেøাগান হোক-আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম, সংগ্রাম।
