Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

কেন ‘চিকেনস নেক’-এ সেনা উপস্থিতি বাড়াচ্ছে ভারত?

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১১:১৪

কেন ‘চিকেনস নেক’-এ সেনা উপস্থিতি বাড়াচ্ছে ভারত?

‘আসামে মুসলিমদের কী হাল করেছে তা তো আপনারা জানেনই। এখন যদি আমরা আসামে ফৌজ আর রসদ ঢোকা বন্ধ করতে পারি, সেখানে যাওয়ার রাস্তা কেটে দিতে পারি, তাহলেই কেল্লা ফতে। আর এটা খুবই সম্ভব।  কারণ যে চিকেনস নেক ভারতের সঙ্গে আসামের সংযোগ ঘটাচ্ছে, সেটা তো আমাদের মুসলিমদেরই এলাকা।’ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আয়োজিত এক সমাবেশে এই বক্তৃতা দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মুসলিম অধিকারকর্মী শার্জিল ইমাম। এই তরুণ জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি (জেএনইউ) এবং মুম্বাই আইআইটির সাবেক ছাত্র। এখনো তিনি কারাগারে। অনেকবার তার জামিনের আবেদন করা হলেও আদালত তাকে জামিন দেননি। তা ছাড়া তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা। ফলে একটি মামলায় জামিন হলেও অন্য মামলায় আটক থাকতে হয়। একজন তরুণ শিক্ষার্থীর ওই বক্তব্য আসামের রাজ্য সরকার তো বটেই, খোদ দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকেও বিব্রত করেছিল বা ক্ষুব্ধ করেছিল। তার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, যে চিকেনস নেক বন্ধ করে দিয়ে তিনি ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যকে (অরুণাচল, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়) দিল্লিসহ ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলেছিলেন, সেই চিকেনস নেক ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রসঙ্গত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাকি দেশকে সংযুক্ত করে রেখেছে মাত্র ২২ কিলোমিটার লম্বা যে সরু ভূখণ্ড, সেটি শিলিগুড়ি করিডর নামে পরিচিত হলেও আন-অফিশিয়ালি এটিকে বলা হয় ‘চিকেনস নেক’ বা মুরগির গলা। করিডরটির পশ্চিমে নেপাল, পূর্বে বাংলাদেশ আর উত্তরে ভুটান অবস্থিত। উপরন্তু স্থলপথে ভারতের সিকিম রাজ্যে যাওয়ার জন্যও শিলিগুড়ি হয়ে যেতে হয়। যে রাজ্যের সঙ্গে রয়েছে চীনের সীমান্ত। এসব কারণে শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেনস নেক নামে পরিচিত এই সরু ভূখণ্ডটি ভারতের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভবিষ্যতে কোনো সংঘাতে চীন বা পাকিস্তানের মতো বৈরী দেশগুলো এই করিডরকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে, অথবা বাংলাদেশের দিক থেকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে করিডরটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ সরু এই এলাকাটি সত্যি বন্ধ করে দেওয়া হলে বা এই এলাকায় কোনো অস্থিরতা তৈরি হলে সেটি পুরো ভারতের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হবে। আবার কোনো অভ্যন্তরীণ সংঘাত কিংবা আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা স্বাধীনতাকামী কোনো সংগঠন যদি এই চিকেনস নেক বন্ধ করে দেয়, তাহলেও মূল ভারত থেকে সেভেন সিস্টার্স আলাদা হয়ে যাবে। তখন ভারত সরকার এই সাতটি রাজ্যের সঙ্গে স্থলপথে কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না। তাকে তখন হয় আকাশপথে কিংবা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে পণ্য বা মানুষ পরিবহন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক থাকতে হবে। যদি কোনো কারণে চিকেনস নেক বন্ধ হয়ে যায় এবং বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ভালো না থাকে, তাহলে সেটি ভারত সরকারের জন্য বিরাট উদ্বেগের কারণ হবে। যে কারণে সরু এই ভূখণ্ডে সুরক্ষা তথা এই জায়গাটি শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে ভারত সরকার তৎপর থাকে। সম্প্রতি এই এলাকায় ভারতের উপস্থিতি বাড়ানোর কারণে চিকেনস নেক নতুন করে আলোচনায় এসেছে। প্রশ্ন হলো, ভারত হঠাৎ করে কেন চিকেনস নেক নিয়ে তৎপর হলো? ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের খবর বলছে, বাংলাদেশ সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে ভারত। সম্প্রতি ভারতের অংশে ধুবড়ীর কাছে বামুনা, কিশানগঞ্জ এবং চোপড়া অঞ্চলে তিনটি নতুন সেনা ঘাঁটি বসিয়েছে দেশটি। এসব ঘাঁটির উদ্দেশ্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেনস নেকের সুরক্ষা। গত ৮ নভেম্বর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আর সি তিওয়ারি উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি নবগঠিত ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। ভারতীয় সেনাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ও যেকোনো ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান তিনি।  চিকেন নেক করিডর থেকে ধুবড়ীর কাছে বামুনা সামরিক স্টেশনের দূরত্ব ২২২ থেকে ২৪০ কিলোমিটার, চোপড়া থেকে ৫২ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেও এই ঘাঁটিগুলোর গড় দূরত্ব খুব বেশি নয়। সামরিক ভাষায় এই ঘাঁটিগুলোকে বলা হচ্ছে গ্যারিসন। জানা যাচ্ছে, এক একটি ঘাঁটিতে ৮০০ থেকে ৯০০ জন সেনা থাকতে পারবেন। ভারী যুদ্ধাস্ত্রসহ ব্যাটালিয়ানকে বাংলাদেশ সীমান্তের ধারে-কাছে রাখতেই এই গ্যারিসন তৈরি। 

গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর গত বছরের ৬ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ ও চীন সীমান্তের কাছে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে ভারত। ইন্ডিয়া টুডে বলছে, চলমান বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে সীমান্তে নজরদাড়ি বাড়িয়েছে মোদি সরকার। উদ্দেশ্য, চিকেন নেকের মতো অতি স্পর্শকাতর এলাকায় কোনো ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত সামরিক বাহিনী মোতায়েন, সীমান্তে নজরদারির সক্ষমতা বাড়ানো এবং চিকেনস নেক এলাকায় সম্ভাব্য দুর্বলতা কমানো। বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তে এই তিনটি নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এখানে ভারতীয় সেনাদের সবচেয়ে আধুনিক ট্যাংক ও যুদ্ধাস্ত্র দেওয়া হচ্ছে।

তিনটি নতুন ঘাঁটিতে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি এবং মোবাইল জ্যামিং সিস্টেম। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, এই নতুন ঘাঁটিগুলো স্থাপন করা তাদের জন্য পূর্ব সীমান্তে সবচেয়ে বড় সামরিক সিদ্ধান্ত, যা সীমান্ত নিরাপত্তা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা বাড়াবে। এগুলো ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন হিসেবে কাজ করবে। ভারী যুদ্ধাস্ত্রসহ ওই ব্যাটালিয়নকে বাংলাদেশ সীমান্তের ধারে-কাছে রাখতেই এই গ্যারিসন তৈরি করা হয়েছে-এমনটাও বলা হচ্ছে। তবে এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, চিকেনস নেককেন্দ্রিক এই তৎপরতা কেবল বাংলাদেশকে মাথায় রেখেই নয়, বরং চীনের কৌশলী সামরিক বিস্তারও এ ক্ষেত্রে দিল্লিকে বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। কারণ চিকেন নেক করিডর যে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে দুর্বল জায়গা, সেটি স্পষ্ট। 

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সম্পর্কের চরম অবনতি এবং তার বিপরীতে ভারতের প্রধান শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মোদি সরকার স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। উপরন্তু অরুণাচল সীমান্তে চীনের সঙ্গে উত্তেজনাও ভারতকে চিন্তায় ফেলেছে বলে মনে করা হয়।  বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মিরজার ঢাকা সফরের পর ভারতের আশঙ্কা আরো বেড়েছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। (ইত্তেফাক, ৮ নভেম্বর ২০২৫)। 

যদিও সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক ১৮ কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ভারত কখনই বাংলাদেশের সঙ্গে বিভেদ চায় না। তবে ভারতকে নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনূসের বিভিন্ন সময়ে করা মন্তব্য নিয়েও সতর্ক করেন রাজনাথ সিং। বলেন, ‘আমরা সব সময় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। তবে আমি আরেকটি কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভারত যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখা। তাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখনই মন্তব্য করবেন, তিনি যেন ভাবনা-চিন্তা করে কথা বলেন।’

অভ্যুত্থানের পরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা, অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েকশ নেতাকর্মী এবং বিগত সরকারের অনেক কর্মকর্তাকে আশ্রয় দিয়ে রাখা যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রধান বাধা হয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। ফলে এসব ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিকেনস নেকে ভারতের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে রাজনাথ সিংয়ের ‘সতর্কবার্তা’ বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলবে, তা এখনই বলা কঠিন।

লেখক : সাংবাদিক 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫