ঢাকা শহরকে কেউ পছন্দ করে? আমি তেমন কোনো মানুষ পাইনি। সবাই এই শহরকে গালি দেয়-পচা, নোংরা শহর যার কোনো নাগরিক সুবিধাও নেই। বহু অভিযোগ, তালিকার শেষ নেই। এত খারাপ লাগে যে সময় সুযোগ পেলেই অনেকেই শহর ছাড়ে-হয় রিসোর্টে যায়, না হয় কক্সবাজার, কুয়াকাটা অথবা সিলেট চা-বাগান। এই শহর মানুষকে ক্লান্ত করে, মনের ভেতরের যে শক্তি তা যেন নিংড়ে শেষ করে দেয়। তাই বাঁচার জন্য এটা দূরে যায়, জিরায়, শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসে থাকতে হবে বলে। করবে নাই বা কেন? কার ভালো লাগে এই শহর?
দুই
আমার ভেতর এই শহরের রক্ত বয়, আমার জন্ম শহর। তাই বলে সেটাকে ‘ভালোবাসা’ বলব না-হয়তো এক ধরনের টান। আর তার বিবরণ দিয়ে ঢাকাকে একটু কম গালাগালি দেওয়ার তদবির করতে চাই না। আসলেই গালিযোগ্য এই শহর। কিন্তু আমি তো বাঁধা এই শহরের কাছে, যেটাকে সাধারণ সুবিধা-অসুবিধার সূচক দিয়ে বোঝাতে পারব না। পাঞ্জাবি সুফি সাধক বুল্লে শাহ যেমন লিখেছিলেন, ‘আমার তো তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু নেই, আমার সুখ আর শান্তি ছাড়া। তাই দিলাম, তার বদলে হাতটা ধরে কাছে টেনো না।’ ঢাকা আমাকে সুখ, শান্তি, সুবিধা কিছুই দেয়নি, শুধু কাছে টেনে নিয়েছে। এটাই সত্য। এটাকে এক ধরনের মিস্টিক নগর মগ্নতা ছাড়া কি বলব?
তিন
সেদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যেটা অনুভূতি, উপলব্ধি বলা যায়, কিন্তু ঠিক বুঝলাম না। খুব সহজ-সরল ঘটনা। আমার দুইটা বালিশ আর একটা চাদর কেনার দরকার ছিল। আমি মধ্য পকেটের মানুষ, তাই মিডিয়াম শ্রেণির দোকান খুঁজছিলাম। জানলাম মহাখালী বাজারে পাওয়া যাবে। তিতুমীর কলেজের কাছে লোককে যখন জিজ্ঞাসা করছি এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলেন, ‘আপনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির টিচার না। আগে টক শো করতেন, আজকাল দেখি না কেন?’ বললাম, ‘ভাই, যা ঝগড়া হয় শুনি, যাবার ইচ্ছা করে না। তিন-চার বছর থেকে অফ আছি।’
ভদ্রলোক বলল, ‘আপনাকে সাহায্য করা আমার উচিত। আমি এই এলাকার বিএনপি নেতা, আমার সঙ্গে আসেন, দোকান দেখিয়ে দিচ্ছি।’ তিনি হেঁটে আমাকে গলির ভেতরে নিয়ে দোকানে উঠিয়ে ‘টক শোতে যাবেন’ বলে মিলিয়ে গেলেন। দোকানদার আমাকে খাতির করে ভেতরে বসতে দিলেন বালিশ, লেপ, চাদর, কাপড়ের স্তূপের মাঝে।
চার
দোকানে বসে আমি দেখছিলাম চারদিকের জীবনটা, যেটা একটা সিনেমার মতো চলছে যেন। দৃশ্যের পর দৃশ্য, বিচ্ছিন্ন; কিন্তু জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার অদৃশ্য সুতা দিয়ে গাঁথা। কেউ বিভিন্ন দোকানে যাচ্ছে, সওদাপাতি নিয়ে বের হচ্ছে এদিকে-ওদিকে, কিনছে-দেখছে, রাস্তা দিয়ে মানুষ হাঁটছে, কথা বলছে, তর্ক করছে, রিকশার স্রোত যেন নদীর ঢেউ-এসব কথা কাব্য কাব্য মনে হচ্ছে? না, কোনো কাব্য ছিল না; কিন্তু হাজারো দৃশ্য যেন এক ধরনের সংগীতের বাহন আর সবাই মিলে এক অর্কেস্ট্রা। যেন হাজার সুরের মূর্ছনা নিজ গতিতে যাচ্ছে, কিন্তু সবার গন্তব্য একই, সবাই যাচ্ছে একসঙ্গে।
সবাই জানে কার কী কাজ। দোকানে বসে মানুষের কাজ দেখছিলাম। একজন বৃদ্ধ কাপড় কাটছে, তারপর উঠে দাঁড়াল, হেঁটে গিয়ে রাস্তার এক বৃদ্ধকে হাত ধরে তুলল, যেন এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ...ঢাকার মূল রাস্তায় এটা কেউ দেখবে না। এটা ঘটে কেবল গলিতে। ঢাকা থাকে গলিতে। শেষে দুটি বালিশ, বালিশের কাভার, একটা চাদরের বস্তা নিয়ে রিকশা ধরতে নামলাম। দোকানদার ঠিক করে দিল। ওইখান থেকে নিকেতন বাজার গেট ৪০ টাকা। ৫০ টাকাও নেয় অনেক রিকশাওয়ালা। তবে আজকাল যাত্রীর হাতে একটু দামাদামির সুযোগ আছে। রওনা হলাম শেষ বিকেলে।
পাঁচ
চিপা গলি দিয়ে রিকশাটা যাচ্ছে, চারদিকে মানুষ আর তাদের জীবনযাপন যেন কোনো অলৌকিক দোকান, পসরা সাজিয়ে বসে আছে বেঁচে থাকার জন্য, মানুষ দেখছে সারি সারি চোখ দিয়ে। ওটাই গলির জীবনের কেনাবেচা। ওই সব সম্ভার কারো হয় না, যে মালিক তারই থেকে যায়, কিন্তু যে দেখে তারও হয়ে যায়। এক স্থানে গিয়ে জ্যাম বাধল রিকশার, অহরহ হয়। যারা এই পথে আসে তারা জানে এটা যাত্রারই অংশ।
সাঁঝের আগে এই জ্যাম বিরক্ত লাগে না আমার। আমি দেখছিলাম একটু আলো-আঁধারির মাঝে বাড়ি-ঘর, পুরান ভাঙাচোরা দালান, টিনের ঘর, হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা ছয়তলা নতুন বিল্ডিং, রাস্তায় হাঁটা মানুষ, রাস্তায় খেলা করা বাচ্চারা-সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত দেখা-না দেখা দৃশ্য, যেন এই নোংরা, বিশৃঙ্খল, ছড়ানো-ছিটানো দৃশ্যে আস্তানা গেড়েছে এক অপরূপ বাস্তবতা, যার কোনো নাম আমার জানা নেই। আর আমার মনের ভাব যদি বলি সেটা এক অদ্ভুত আত্মসমর্পণ বোধ, যেন সব মেনে নিলাম, সব মেনে নিয়েছি। আমার মনের মানুষের সঙ্গে মিলন ঘটছে।
ছয়
ওই অসম্ভব ক্ষণকে কী নামে ডাকব ‘ফানাহ’ ছাড়া? যেন আমি আমার শহরের আত্মার সঙ্গে মিলে গেছি, মিশে গেছি, ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে যে বোধ যেটা বলে, ‘তুমি যা দেবে আমি তাই হাত পেতে নেব। আমি এক অনাবিল সীমাহীন সমর্পণের অনুভূতি নিয়ে বসে রইলাম রিকশায়।
একসময় জ্যাম ছাড়ল, একসময় রওনা হলাম, সরু সর্পিল বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে একসময় বাজার গেট পৌঁছালাম যেন অপার্থিব কোনো মায়ার অলৌকিক চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে। রিকশাওয়ালাকে ৫০ টাকা দিলাম, ওটাই ন্যায্য ভাড়া জানি। ও আমার পিঠে চাপড় মারল। ‘যান, সাবধানে, যান।’ এমনটা কোন শহরে হয়? তারপর রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেল। আমি আর একটা রিকশা ধরে বাকি পথ যেতে রওনা হলাম।
সাত
যেভাবে আমার আফগানি পূর্ব-পুরুষ প্রাচীন সুফি তরিকায় নিজেদের ফানাহ খুঁজে পেত, আমিও কি একইভাবে এই শহর ও আমার মাঝ্যে সেই নৈকট্য লাভ করেছি। সাধারণ অভিজ্ঞানের ভাষায় যা বোঝানো যায় না, কেবল উপলব্ধি করা যায়? এই নোংরা দূষিত শহরের আত্মা আর আমার অন্তরের কোথাও মিলেছে, যাতে ভালো-মন্দের পার্থিব বন্ধনের চেয়ে অধিক কিছু? জানি না, তবে এই শহর আমার শহর, আর আমি এই শহরের।
