এখন থেকে যতদিন ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে থাকবেন, ঘুমাতে গেলেই মামদানির কণ্ঠে শুনতে পাবেন, ‘টার্ন দ্য ভলিউম আপ!’ আর বেচারা হয়তো চিৎকার করে উঠবেন-কুমোকে ভোট দাও। নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি তার বিজয় ভাষণে ট্রাম্পকে বলেছেন, আওয়াজ বাড়ায়ে শুনতে। বলেছেন, নিউইয়র্ক অভিবাসীদের শহর আর ১ জানুয়ারি থেকে নিউইয়র্ক চালাবে একজন অভিবাসী। মামদানি তার ভাষণ শুরু করেছেন শত বছর আগের বিখ্যাত মার্কিন সমাজতান্ত্রিক নেতা ইউজিন ডেবসের একটি উক্তি দিয়ে : ‘আমি মানবতার জন্য আরো একটি ভালো দিনের প্রভাত দেখতে পাচ্ছি।’
মামদানির ভাষণে ডেবসের ভাষণের মতই সৌন্দর্য, সরলতা, সহজবোধ্যতা ও অকাট্য যুক্তি বিদ্যমান। মামদানির এই বিজয় ভাষণটির মতই ঐতিহাসিক বলে বিবেচিত তার ২৬ অক্টোবর কুইন্সের টেনিস স্টেডিয়ামে প্রদত্ত ভাষণটি। বার্নি স্যান্ডার্স ও আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কোর্তেজের উপস্থিতি দ্বারা আলোকিত সভায় জোহরান মামদানি অবিচলিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘নিউইয়র্ক, ৪ নভেম্বর আমরা স্বাধীন হতে চলেছি।’
স্মরণকালের সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতিতে ও ভয়ংকর সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী শহরটিকে সত্যি তিনি দরিদ্রদের জন্য মুক্ত করে ছাড়লেন। আর বিজয় ভাষণে জানালেন, নিউইয়র্ক দেখালো ট্রাম্পকে কী করে পরাজিত করতে হয়। তবে লক্ষণীয় যে বিজয়ের আগে ও পরে উভয় সময়ই তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, মুক্তির উদ্যোগ শুরু হয়েছে মাত্র।
কুইন্সের ওই অসামান্য ভাষণে মামদানি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন এই শহরকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও দখলদার বিলিয়নেয়ারদের হাত থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন আমাদের কথা এমন উচ্চলয়ে ধ্বনিত হোক যেন অ্যান্ড্রু কুমো তার মাসে আট হাজার ডলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকেও শুনতে পায়। এত জোরে ধ্বনিত হোক যে হোয়াইট হাউসে তার প্রভুও যেন শুনতে পায় যে : নিউইয়র্ক বিক্রির জন্য নয়।’
এই কথাগুলো কুমোর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ইলন মাস্কের অ্যাপার্টমেন্ট ও ট্রাম্প টাওয়ার হয়ে নেতানিয়াহুর অট্টালিকা ছুঁয়ে বিশ্বের সব দুর্নীতিবাজ, ধনলিপ্সু ও যুদ্ধবাজদের কানে পৌঁছেছে ও কাঁপন ধরিয়েছে কারো কারো হৃৎপিণ্ডে। কথাটা অতিরঞ্জন নয়, নিরেট সত্য-কেননা সারা বিশ্ব উন্মুখ হয়েছিল নিউইয়র্কে মঞ্চস্থ এই নাটকের শেষ অঙ্ক দেখার জন্য। এর প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নয়, বিশ্বব্যাপী সমগ্র মার্কিন বলয়েই পড়বে।
ভাববার কোনো কারণ নেই যে, মামদানির এই বিজয় আচমকা কিছু ছিল। এর পেছনে রয়েছে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার নিউইয়র্ক চ্যাপ্টার অর্থাৎ এনওয়াইসি-ডিএসএ। তাদের পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিজয় এটি। এ বিজয় নিউইয়র্কের দরিদ্র মানুষের, অভিবাসী নাগরিকদের, রাত-দিন কাজ করা এক লাখ স্বেচ্ছাসেবকের, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-ইহুদিসহ সব প্রগতিশীল মানুষের। এ বিজয় বার্নি স্যান্ডার্সের, ওকাশিয়ো-কোর্তেজের, মার্টিন লুথার কিংয়ের ও ইউজিন ডেবসেরও। এ এক সম্মিলিত বিজয়, তাই এ বিজয়ের কাঁধে দায়িত্বও অনেক বেশি।
মামদানির এ বিজয়ের কারণ খোঁজা শুরু করবেন তার প্রধান প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে। মামদানির কথামতোই তার বক্তৃতা যে ট্রাম্প উচ্চ ভলিউম দিয়ে শুনেছেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ খুঁজে প্রথম যা পাবেন তা হলো, তার সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর দুর্নীতি ও অযোগ্যতাই তার পরাজয়ের ও প্রতিপক্ষ মামদানির বিজয়ের মূল কারণ। কিন্তু এই দুর্নীতি ও অযোগ্যতা ব্যক্তিবিশেষের নয়-পুরো ব্যবস্থার, যার প্রধান এখন ট্রাম্প। আর এই ব্যবস্থাটিকেই পরিবর্তনের প্রতিজ্ঞা করেছেন মামদানি।
ট্রাম্প ও তার পুতুল অনুসারীদের নামতে হবে আরো এক আত্ম-অনুসন্ধানে। তারা কল্পনাও করতে পারেননি, যে অস্ত্রগুলো তারা মামদানির বিরুদ্ধে শাণ দিয়েছিলেন তা বুমেরাং হয়ে তাদেরই কুপোকাত করেছে। ট্রাম্পরা সারাক্ষণ বলেছেন, সে একজন কমিউনিস্ট, সে একজন মুসলমান, সে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সমর্থক, সে নেতানিয়াহুকে গণহত্যার দায়ে আটক করতে চায় ইত্যাদি। আশ্চর্য হলো, যেগুলোকে তারা মামদানির দুর্বলতা মনে করেছিলেন, তিনি সেগুলোকেই বরং তার শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন।
এ যুক্তিগুলোই স্পষ্টভাবে এসেছে ৪ নভেম্বর জ্যাকোবিন সাময়িকীতে মাইকেল কিনুচানের লেখায় (How Zohran Mamdani Triumphed Over a Decrepit Establishment) : ‘মামদানি যখন তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেন তখন ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি তার দৃঢ় নীতিনিষ্ঠ ও প্রকাশ্য সমর্থন মনে হয়েছিল প্রার্থী হিসেবে তার বড় সমস্যা-এমনকি এটি তার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী পরিচয়ের চেয়েও বড় হয়ে ওঠার বিপদ। কিন্তু ঘটল ঠিক তার উল্টা, হয়ে গেল এক শক্তিমান সম্পদ। অনেক ভোটার (বিশেষ করে, যদিও একমাত্র নয়, তরুণ ও মুসলিম ভোটারদের কাছে) ইসরায়েলি গণহত্যার ব্যাপারে মূলধারার ডেমোক্র্যাটদের চতুর উপায়ে মুখ বুজে থাকার প্রতি বিতৃষ্ণা অনুভব করেছেন। সে ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মামদানির কোনো ছাড় না দেওয়ার দৃঢ়তা এবং ফিলিস্তিনিদের সমানাধিকারের জন্য তার সমর্থন পরিণত হলো তার সাহস ও সততার পরিচয়ে, কেবল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্নে নয়, আরো প্রশস্ত পরিসরে।’
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো কুমোর পরাজয়ের কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন তার প্রতি ট্রাম্পের অকুণ্ঠ সমর্থন। স্পষ্টতই কুমোর ট্রাম্পিয়ান শক্তিকে মামদানি তার প্রধান দুর্বলতা হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এ কথা বারবার বলে যে কুমো কিছুই না, ট্রাম্পের কেনা গোলাম ছাড়া। এই নির্বাচনী যুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখোমুখি হয়েছেন তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মামদানির, যিনি ট্রাম্পের প্রতিটি বহুল ব্যবহৃত অব্যর্থ অস্ত্রকে অব্যর্থভাবে ট্রাম্পের নিজের বুকের দিকেই ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
মামদানি হচ্ছেন বার্নির সবচেয়ে শক্তিশালী উত্তরাধিকার। বার্নির লাগাতার আন্দোলনই রচনা করেছে মামদানির বিজয়ের পথ। আর বার্নির রাজনৈতিক কৌশলই অবলম্বন করেছেন তিনি। নীতি ও আদর্শের বেলায় স্পষ্ট, পক্ষাবলম্বন আর বিরোধিতা উভয় ক্ষেত্রে প্রকাশ্য, শ্রমজীবী মানুষের ওপর আস্থা, তাদের স্বার্থের পক্ষে আপসহীন অবস্থান ইত্যাদি মামদানির রাজনীতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। এই নীতিগত বৈশিষ্ট্যেরও একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে-ইউজিন ডেবস থেকে বার্নি হয়ে মামদানি পর্যন্ত। বেন বুর্গিস লিখেছেন, মামদানির মাঝে দেখা যায় তরুণ বার্নিকে। (জোহরান ইজ টেকিং বার্নি’স মুভমেন্ট ইনটু দ্য ফিউচার, জ্যাকোবিন, ৫ নভেম্বর ২০২৫) লক্ষণীয় যে, বার্নি ১৯৭৯ সালে ইউজিন ডেবসকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন এবং তার ওয়াশিংটন কার্যালয়ের দেওয়ালে ডেবসের ছবি, যিনি তার মতে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকানদের একজন।
মামদানির এ বিজয় একটি বৈশ্বিক বার্তা দিচ্ছে, আর তা হলো সত্যিকারভাবে বৈষম্যের বিরোধিতা করে শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে তাদের আস্থা অর্জন করবে, কোনো অর্থশক্তি ও ক্ষমতার দাপট তার বিজয় রুখতে পারবে না। নিউইয়র্কে ট্রাম্পিয়ান যুগ শেষ হয়ে মামদানির যুগ শুরু হলো-হয়তো অন্যত্রও।
