Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

ব্রহ্মপুত্রের উজানে ভারতের আরো ছোট-বড় ‘ফারাক্কা’

Icon

গৌরাঙ্গ নন্দী

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:১৪

ব্রহ্মপুত্রের উজানে ভারতের আরো ছোট-বড় ‘ফারাক্কা’

আমাদের ব্রহ্মপুত্রের উজানে ভারত আরো একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, এতে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। তাদের এই কথার আড়ালে ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় না নেওয়ার যে উন্মত্ততা দেখা দিয়েছে, সেটিই ভয় ও উদ্বেগের। উজানের এই জলবিদ্যুৎগুলো ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের জন্য যেমন ক্ষতিকর; তেমনি এই অঞ্চলের বিশেষ ভূ-প্রকৃতির জন্য খুবই বিপজ্জনক। অবশ্য তিব্বতে ইয়ারলু সাংপোতে বিশ্বের বৃহত্তম ড্যাম তৈরি করার চীনা পরিকল্পনা ভারতের এই প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। উজানের এই দুটি দেশের প্রতিযোগিতা ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে ভোগান্তির মুখে ফেলে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। 

তিব্বতের ইয়ারলু সাংপো ভারতের অরুনাচল প্রদেশে এসে সিয়াং নামে পরিচিত হয়েছে; আসামে সেই নদীর নাম ব্রহ্মপুত্র, ভাটিতে আমাদের দেশেও সেই একই ধারার নাম ব্রহ্মপুত্র। বিস্ময়কর হচ্ছে, ইয়ারলু সাংপোয় বাঁধের কারণে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে; সেই ভারত একই ধরনের বাঁধ সিয়াংএ তৈরি করছে। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত নিজেকে চীনের ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছে। ভারত যে কারণে, যে উদ্যোগের ফলে ভাটির দেশ হিসেবে নিজের (ভারত) ক্ষতি হবে আশঙ্কায় চীনের সমালোচনা করছে; বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, সে একই আচরণ করছে তার ভাটির দেশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। ভাটির দেশ হিসেবে, সবচেয়ে বিপদের আশঙ্কার মধ্যে থাকা বাংলাদেশ-চীন বা ভারতের উদ্যোগ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের কোনো উদ্বেগ জানিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়নি।    

চীনের এই বড় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটিকে ভারত পানিকে অস্ত্র হিসেবে এবং নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে ব্যবহার করছে বলে মনে করছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন যে, চীন ‘ভারতের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করতে’ উজানের নদীর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। এই প্রকল্পগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। উজানের জল নিয়ন্ত্রণ করে আচমকাই চীন বিপুল পরিমাণে জল ছেড়ে দিতে পারে; যার ফলে অরুণাচল ও আসামে আকস্মিক বন্যা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতিকে তারা ‘জলবোমা’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তাদের উদ্বেগের মধ্যে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিবেচনায় আসেনি। কারণ তারাও ফারাক্কা ও তিস্তায় বাঁধ দিয়ে জল নিয়ন্ত্রণ বা সরিয়ে নিয়ে ব্যবহার করে, তখন বাংলাদেশ জল পায় না; আবার বর্ষার সময় সেখানকার অতিরিক্ত জমা জল ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে অকাল বন্যার সৃষ্টি করে। আটকে রাখা জলকে তারাও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। 

চীনের বাঁধ তৈরির সমালোচনা করে ভারত আরো বলেছে যে, শুষ্ক মৌসুমে চীন জল আটকে রাখতে পারে, যাতে ভাটিতে প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাবে। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খাণ্ডু উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, বাঁধটি তৈরি হওয়ার পর সিয়াং এবং ব্রহ্মপুত্র নদী শুকিয়ে যেতে পারে, যা স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে। এক সরকারি বিশ্লেষণে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, চীনের বাঁধের কারণে গুয়াহাটির মতো একটি প্রধান আঞ্চলিক শহরেও জলপ্রবাহ ২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। উপরন্তু, চীনের বাঁধটি  ভূতাত্ত্বিকভাবে অস্থিতিশীল, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় নির্মিত হচ্ছে; যা ভূমিধস, হঠাৎ হিমবাহ ফেটে যাওয়া বা কাদা ধসের মতো ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যা ভাটির অঞ্চলগুলোর জন্যও একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। 

ভারত এসব কারণে চীনের এই বাঁধ তৈরির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে; পাশাপাশি তারা ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে ‘স্বচ্ছতা ও পরামর্শের’ প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। এ ছাড়া ভারত দাবি করেছে যে, চীনের ওই বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের কোনো ক্ষতি হবে না-এমন নিশ্চয়তা চীনকে দিতে হবে।  

এতসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরও ভারত একই ধরনের বাঁধ নির্মাণের পাল্টা উদ্যোগ নিয়েছে। যাকে বলা যায়, ‘বাঁধের জন্য বাঁধ’ পদ্ধতি। ভারত দাবি করছে যে, মূলত প্রতিরক্ষামূলক কৌশল হিসেবে অরুণাচল প্রদেশে বিশাল অভ্যন্তরীণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যাকে তারা ‘কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা’ এবং চীনের সম্ভাব্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই প্রতিরক্ষামূলক কর্মসূচির অংশ হিসেবে দিবাং বহুমুখী প্রকল্প ও উচ্চ সিয়াং বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।  

দিবাং বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত দুই হাজার ৮৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের এই বাঁধটি হবে ভারতের সর্বোচ্চ কংক্রিট মাধ্যাকর্ষণ বাঁধ। ২০৩২ সালের মধ্যে এটি কার্যকর হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে উচ্চ সিয়াং বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ১১.২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে চায়। এটি হবে ভারতের বৃহত্তম বাঁধ। এই বাঁধগুলোর মাধ্যমে আনুমানিক ৯ বিলিয়ন ঘনমিটার জল ধারণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে চীনা বাঁধের প্রতিকূল প্রভাব নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চীন থেকে আকস্মিক, অতিরিক্ত জল নিঃসরণ শোষণ করতে পারবে, যাতে বিপর্যয়কর বন্যা রোধ করা যাবে। আবার চীন যদি পানিপ্রবাহ অন্যদিকে সরিয়ে নেয় বা আটকে রাখে, তাহলে ভারত বর্ষা মৌসুমে নদীর প্রবাহ পুনরায় নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।  

‘বাঁধের বিনিময়ে বাঁধ’ নির্মাণের এই কৌশলের মাধ্যমে ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষা করছে। তারা চীনা বাঁধের কারণে যেসব ক্ষতির আশঙ্কা করছে, সেসব ক্ষতি দ্বারা বাংলাদেশও আক্রান্ত হবে। উপরন্তু, ভারতের তৈরি একাধিক বাঁধের কারণে ভাটির দেশ বাংলাদেশ আরো বিপদের মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশ এমনিতেই ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের কারণে নানামুখী পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার।

ফারাক্কার প্রভাবে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাগরের নোনা পানির অনুপ্রবেশ বেড়েছে, মরুময়তা দেখা দিয়েছে, নদী মরছে। তেমনিভাবে তিস্তার কারণে ভাটিতে পানিপ্রবাহ কমেছে এবং উজানে আটকে রাখা বৃষ্টির পানি আচমকা ছেড়ে দেওয়ায় তিস্তা অববাহিকায় বন্যা প্রায় নিয়মিত ঘটনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুধু ভাটির দেশেই নয়, তাদের দেশেও এই বাঁধগুলো প্রাকৃতিক ও সামাজিকভাবে মহাবিপর্যয়কর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ওই এলাকায় হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশের আদি উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ স্থায়ীভাবে স্থানচ্যুতির (মাইগ্রেট) আশঙ্কা করছে। উপরন্তু, তাদের কাছে তাদের পবিত্র ভূমি হতে উচ্ছেদের চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর পরিবেশগত সমস্যা তো রয়েছেই, যা এক মহাবিপর্যয় ঘটাতে পারে। 

ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা, বিশেষ করে হিমালয়, অরুণাচল প্রদেশ এবং তিব্বতের যেসব অঞ্চলে বড় বড় বাঁধ প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়েছে বা চলছে, সেই স্থানটি ভূমিকম্পপ্রবণ। ভূতাত্ত্বিকভাবে স্থানটি অস্থির এবং ভূমিকম্পের দিক দিয়ে সক্রিয় অঞ্চল। এই অঞ্চলে অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে; যেমন-১৯৫০ সালের আসাম-তিব্বতের ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৮.৭।

এর আগে ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান প্রবাহকে একটি বড় পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দেয়, যাতে মধুপুর নদীর টেকটোনিক উত্থান ঘটে; এর প্রতিক্রিয়ায় যমুনাপ্রবাহ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ভারতের দিবাং বাঁধ এলাকায় এরই মধ্যে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এতসব বিপর্যয় অবস্থার বিবেচনা না করেই চীনের মেগা-বাঁধ তৈরির স্থানটি হচ্ছে ভূমিকম্পের ফল্ট লাইনের বিস্তৃত অঞ্চল। ভূতাত্ত্বিকভাবে অস্থিতিশীল এবং ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে এই বাঁধ নির্মাণের ফলে ভূমিধস; আচমকা হিমবাহ ফেটে যাওয়া এবং কাদা ধস ঘটাতে পারে। চীনের বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে ভারতের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সেই একইভাবে তারা বাংলাদেশকে আরো বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ভারতের দিবাং ও সিয়াং বহুমুখী প্রকল্প দুটি একই ধরনের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃহৎ সংরক্ষণাগার বাঁধ নির্মাণের পরে ভূমিকম্প বা অতি-বৃষ্টিতে পানি যদি সংরক্ষণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তবে বাঁধ রক্ষায় পানি ছেড়ে দিলে মানবসৃষ্ট বন্যা দেখা দিতে পারে, যা আমরা ভারতের তিস্তা বাঁধ এলাকায় মাঝেমধ্যে দেখে থাকি। সার্বিকভাবে এই বাঁধের প্রতিযোগিতা হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র এবং এই অঞ্চল তথা ভাটিতে বসবাসকারী মানুষের জন্য বিধ্বংসী পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অর্থাৎ চীন বাঁধ নির্মাণ করলে ভারত যে ক্ষতির মুখোমুখি হবে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতির দিকে তারা ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির আগেই সংকট নিরসনে এখনই আলোচনায় বসে বিষয়টির সুরাহা করা  দরকার।


লেখক : পরিবেশকর্মী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫