Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

বন্দরের মালিকানা বাংলাদেশের কাছেই থাকছে : চৌধুরী আশিক মাহমুদ

Icon

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৫৪

বন্দরের মালিকানা বাংলাদেশের কাছেই থাকছে : চৌধুরী আশিক মাহমুদ

চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন

নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল নিয়ে চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা নিয়ে একটি এবং ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে অন্য চুক্তিটি হয়। বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে দিলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলছেন, এতে দুর্নীতিমুক্ত বন্দর পাব আমরা। এই বিষয়ে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো সাম্প্রতিক দেশকালে।

চট্টগ্রাম বন্দরে একটি গ্লোবাল অপারেটর কেন জরুরি হলো?

বাংলাদেশের বন্দরে মূল চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি এবং দীর্ঘ ওয়েটিং টাইম। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো হলো ভিয়েতনাম; বৈশ্বিক অপারেটর দ্বারা প্রযুক্তিনির্ভর বন্দর ব্যবস্থাপনা চালু করে তাদের কাই মেপ বন্দরকে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে সপ্তম অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৪০৫টি বন্দরের মধ্যে ৩৩৪তম। আমাদের এমন অপারেটর প্রয়োজন, যারা নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে আমাদের হয়ে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করতে পারবে। আমাদের তরুণ জনশক্তি তাদের কাছ থেকে বন্দর পরিচালনা শিখে একদিন নিজেরাই দেশে-বিদেশে পোর্টের নেতৃত্ব দেবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, একটি দুর্নীতিমুক্ত বন্দর পাওয়ার আশা করতে পারি আমরা। 

পোর্টের মালিকানা কি বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে?

প্রশ্নই আসে না! বন্দরের মালিকানা বাংলাদেশের কাছেই থাকছে। লালদিয়া চরে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস একটি নতুন টার্মিনাল নকশা ও নির্মাণ করবে। যেই বিশ্বমানের টার্মিনাল লালদিয়ায় তৈরি হবে, সেটির মালিক হবে বাংলাদেশ। নির্মাণকাল তিন বছর। তারপর এপিএম একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে। সময় শেষ হয়ে গেলে তারা সব আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবে। মনে করুন, গাড়িটা আমাদের। তারা ড্রাইভার। তাহলে কি গাড়িটা তার হয়ে গেল? 

এপিএম টার্মিনালস কারা? এদের কেন দায়িত্ব দেওয়া হলো?

এপিএম টার্মিনালস বিশ্বখ্যাত এপি মোলার-মেয়ার্স্ক গ্রুপের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের শীর্ষ ২০টি বন্দরের ১০টি অপারেট করে তারা। ৩৩টি দেশে সর্বমোট ৬০টির বেশি টার্মিনাল পরিচালনা করছে এই মুহূর্তে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও চীনে অপারেট করছে তারা। 

চুক্তির মূল শর্তগুলো কী কী? 

লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (চচচ) প্রকল্প। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে:

-প্রাইভেট পার্টনার এর সম্পূর্ণ বিনিয়োগ। সাইনিং মানি হিসাবে ২৫০ কোটি টাকা এবং নির্মাণকালে সব মিলিয়ে প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এপিএম। সরকার থেকে কোনো অর্থায়ন বা গ্যারান্টি প্রদান করা হচ্ছে না। 

-নির্মাণের পর ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি। চুক্তির মেয়াদকালে আমাদের সব বাণিজ্যিক, সামাজিক ও পরিবেশগত শর্ত মেনে চললে মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে। 

-যতগুলো কনটেইনার তারা হ্যান্ডেল করবে, প্রতিটির জন্য আমাদের একটি নির্দিষ্ট ফি দেবে। যত বেশি ভলিউম করবে আমাদের আয় তত বেশি হবে। এর পাশাপাশি দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক ধরনের শর্ত আছে এই চুক্তিতে। যেমন-কোনো কনটেইনার হ্যান্ডেল করতে না পারলেও আমাদের মিনিমাম একটা ভলিউম ধরে তারা পেমেন্ট করবেন। 

-রেগুলেটর হিসেবে থাকছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

৩০ বছরের চুক্তি কি অনেক বেশি দিনের হয়ে গেল না? 

৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি পিপিপি কাঠামোর ক্ষেত্রে একটা মাঝামাঝি মেয়াদকাল। অন্যান্য দেশে একই ধাঁচের চুক্তির মেয়াদকাল : ভারত ২০১৮, মুম্বাই পোর্ট-৬০ বছর, চীন ২০০৩, সাংহাই পোর্ট-৫০ বছর, ভিয়েতনাম ২০১০, কাই মেপ পোর্ট-৫০ বছর। 

চুক্তির পূর্ণাঙ্গ দলিল কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না?   

শুধু বাংলাদেশ না, কোনো দেশের সরকারই পিপিপি চুক্তির মূল দলিল জনসমক্ষে প্রকাশ করবে না আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। সরকারি ক্রয়নীতি ও পিপিপি গাইডলাইন অনুযায়ী পূর্ণ প্রকাশ নিরাপদ নয়, কারণ এটি ভবিষ্যৎ দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা সব প্রকাশ করে ফেললে আগামী সব চুক্তির দর-কষাকষিতে আমরা ব্যাকফুটে চলে যাব। এ ছাড়া চুক্তির দলিলে ব্যাবসায়িক তথ্য ও অপারেশনাল কৌশল থাকে, যা গোপনীয়তার শর্ত দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো সংস্থাগুলোও সম্পূর্ণ চুক্তি প্রকাশ না করে বরং সারাংশ প্রকাশ করার পরামর্শ দেয়। জনগণের অবহতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (যেমন : মালিকানা, আয় কাঠামো) আমরা এর মধ্যে প্রেস ব্রিফিং করে প্রকাশ করেছি এবং সাংবাদিকদেরও লিখিত জানিয়েছি।

অপারেটর বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কি স্বচ্ছ/আইনানুগ ছিল?

পিপিপি নীতিমালার জি টু জি পদ্ধতির আলোকে টেন্ডার আহ্বান, প্রাক-যোগ্যতা যাচাই, টেকনিক্যাল ও ফিন্যানশিয়াল মূল্যায়ন এবং ডিউ ডিলিজেন্সের মাধ্যমে অপারেটর চূড়ান্ত করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিযুক্ত করা হয়েছে নিরপেক্ষ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, আইনজীবী ও কনসালট্যান্ট। গঠন করা হয়েছে আন্ত মন্ত্রণালয় টেন্ডার কমিটি। প্রতিটি ধাপের অডিটযোগ্য রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আমরা কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছি? 

শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর চীনা ঋণে নির্মিত। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কান সরকার ৯৯ বছরের জন্য চীনা কোম্পানির কাছে কন্ট্রোলিং ইকুইটি স্টেক দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। হাম্বানটোটা থেকে আমাদের শিক্ষা হলো যে অতিরিক্ত ঋণনির্ভর কাঠামো ও দুর্বল রিস্ক শেয়ারিং মডেল দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর। আমরা ওই পথে হাঁটিনি। লালদিয়া টার্মিনালের মালিক রাষ্ট্র এবং আগেই বলেছি, এটির জন্য আমরা কোনো ঋণ নেইনি। এটি সম্পূর্ণরূপে এপিএমের বিনিয়োগ। চুক্তিতে ট্রাফিক স্টাডি, রিস্ক শেয়ারিং, কারেন্সি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং স্টেপ-ইন রাইটের মতো বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে অর্থনৈতিক কাঠামো টেকসই ও স্বচ্ছ থাকে। 

অপারেটর ব্যর্থ হলে বা চুক্তি ভঙ্গ করলে কী করবে সরকার?

চুক্তিতে পারফরম্যান্স-ভিত্তিক কেপিআই, রেমেডি ও পেনাল্টির ধারা, স্টেপ-ইন রাইট, টার্মিনেশন এবং হ্যান্ড-ব্যাকের মতো প্রোভিশন অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা জনস্বার্থ সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপারেটর চুক্তি ভঙ্গ করলে বা প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ হলে এসব ধারা অনুযায়ী সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সময়ে পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং বিকল্প ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে পারে।

বিদ্যমান টার্মিনালগুলোর সমস্যা না মিটিয়ে নতুন টার্মিনাল কেন?

বর্তমান টার্মিনালগুলোতে ডিজিটাইজেশন, ইয়ার্ড রিডিজাইন, গেট অপ্টিমাইজেশন, কনটেইনার ব্যবস্থাপনার সংস্কার চলছে। অন্যদিকে লালদিয়ায় বিশ্বমানের কনটেইনার টার্মিনাল যোগ হলে অপারেশনাল প্রতিযোগিতা বাড়বে। বন্দর অবকাঠামোর ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই প্রকল্পটি একই সঙ্গে বটলনেক রিমুভাল ও নতুন সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ করবে। 

সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হচ্ছে কেন?

সারা জীবন শুনলাম সরকারি অফিস ঢিলা। ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট সময়মতো করতে পারলে আমাদের দেশ নাকি কোথায় চলে যেত! এখন যখন সরকারের কিছু অন্তঃপ্রাণ অফিসার লেজার ফোকাস নিয়ে দিনরাত খেটে একটা বড় কাজ এগিয়ে নিয়ে গেল, তখন তো সবার বলা উচিত, ‘দে মেড আস ফ্লাই!’ কারো সঙ্গে মিল খুঁজবেন না। ওটা কাকতাল। 

আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে কি? 

নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ইমিগ্রেশন, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার নিরাপত্তা প্রটোকল যথারীতি বলবৎ থাকবে। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল এই নেটওয়ার্কের মধ্যেই অপারেট করবে। এ ছাড়া টার্মিনালে ব্যবহৃত সব ধরনের প্রযুক্তি ও অপারেশনাল প্রক্রিয়ায় সরকার অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ডেটা লোকালাইজেশন, সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থা, ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিনিং এবং অ্যাক্সেস কন্ট্রোল মেকানিজম নিশ্চিত করা হবে। এই পুরো ব্যবস্থাপনাই সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে, ফলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কোনো সুযোগ নেই।

সব মিলিয়ে দেশের কী লাভ হবে?

প্রতি বছর অতিরিক্ত আট লাখ ফুট ইকুভ্যালেন্ট ইউনিট ধারণক্ষমতা যুক্ত হবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। 

-প্রতি ইউনিটে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে। 

-আমদানি-রপ্তানি দ্রুততর হবে। 

-এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারবে।  

-বিশ্বের দূরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি জাহাজ সংযোগের সুযোগ উন্মুক্ত হবে।

-৫০০-৭০০ সরাসরি স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি হবে নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে। হাজারেরও বেশি পরোক্ষ স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে পরিবহন, লজিস্টিকস ও বৃহত্তর সাপ্লাই চেইনে।

-এপিএম টার্মিনালসের নিজস্ব ট্রেনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকরা বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ পাবেন।

-ডিজিটাল টার্মিনাল অপারেশন সিস্টেম, লিয়েন পদ্ধতি ও ফ্লো ফ্রেম ওয়ার্কের মাধ্যমে প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তর হবে।

-আমাদের প্রথম পরিবেশবান্ধব গ্রিন পোর্ট হবে এটি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫