বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাঙা সুটকেস একটি বহুল আলোচিত শব্দ। যে শব্দের সঙ্গে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম জড়িয়ে আছে। জিয়াউর রহমানের সততার প্রমাণস্বরূপ মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাওয়া তার ভাঙা সুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জির উদাহরণ দেওয়া হয়। আজ আমরা আলোচনা করব আমাদের আরেকজন অবিসংবাদিত নেতা মওলানা ভাসানীর ভাঙা সুটকেস নিয়ে। উপমহাদেশের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী শীর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি মওলানা ভাসানী। তিনি ছিলেন দীর্ঘ কর্মময় ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী।
১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশের এমন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, যার নেতৃত্ব তিনি দেননি। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ছিল খুবই কৌতূহল উদ্দীপক। তার জীবনের নানা ঘটনা আমাদের বাড়িতেও আলোচনা হতো। মা বলতেন, তার পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। মওলানা ভাসানী যখন রাজনৈতিক কাজে বাগেরহাটে যেতেন, তখন আমার নানার (মাতামহ) বাড়িতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। তার জন্য বড় রাজহাঁস, বড় বড় সব মাছ আর বিশেষ করে কিশমিশের খাট্টা রান্না করা হতো। আবার ধনী ব্যক্তির বাড়িতে যে ধরনের আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন, গরিবের বাড়িতে তেমন নয়। ভাসানী গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি-১৯৪০-এর দশকে ধুবড়ির আশপাশের গ্রামের এক বৃদ্ধা প্রায়ই যেতেন মওলানার কাছে। তার আবদার তিনি মওলানাকে একবেলা খাওয়াবেন। অনেক বছর ধরে হুজুরকে খাওয়াবেন বলে তিনি মনস্থ করে আছেন, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছেন না। মহাব্যস্ত মওলানা বৃদ্ধাকে বলেন, ‘তোমার বাড়িতে খেতে যেতে পারি, যদি তুমি আমি যা বলি তাই খাওয়াও। বৃদ্ধা বলেন, মওলানা যা খেতে চাইবেন, তাই খাওয়াবেন।’
মওলানা বলেন, ‘শুধু ভাত আর লাউপাতা ভর্তা খাওয়াবে। এর বেশি হলে আমি তোমার উঠান থেকে সোজা চলে আসব।’ বৃদ্ধা তাকে খাওয়াবেন বলে মোরগ পেলে রেখেছেন, মাষকলাইয়ের ডাল ভেজে রেখেছেন, হুজুর এসব কিছুই খাবেন না! মওলানা বলেন, ‘মোরগ-মুরগি না, শুধু যদি লাউপাতা ভর্তা খাওয়াতে পারো, তো যাব।’
বৃদ্ধা নাছোড়বান্দা, শুধু লাউপাতা ভর্তা খাওয়াতে তিনি রাজি নন। অবশেষে মওলানা সামান্য ভেবে মাষকলাইয়ের ডাল ও লাউপাতা ভর্তায় রাজি হন। মূলত সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র বৃদ্ধাকে তিনি আশাহত করতে চাননি, আবার তার ওপরে চাপ পড়ুক সেটাও চাননি তিনি।
তবে তিনি তার নিজ বাড়িতে মজাদার ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খেতে ও লোকজনকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। খাদ্যের বেলায় তিনি যত বিলাসিতা করতেন, জীবনাচরণে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। আমরা আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের তোলা ছবিতে দেখতে পাই, মওলানা ছনের ঘরে বসবাস করতেন। তিনি যখন আসামে পাড়ি দেন, সেখানেও তিনি একটি ছনের ঘর বানিয়েছিলেন নিজের জন্য। তার বর্ণনা মতে, সেখানে মশাগুলো এত বড় বড় ছিল যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যেত।
ভাসানী তখন আসামের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, আসামের কৃষক শ্রেণির জনগণ তার কথায় প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকত। তখন লাইন-প্রথাবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। তার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বড় বড় সব নেতা, এমনকি লীগেরও সামন্ত শ্রেণির বহু নেতা। সেই সময়ে আবদুল মতিন চৌধুরীর স্ত্রী মওলানার আমন্ত্রণে তার বাড়িতে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এত বড় নেতা, নিশ্চয়ই বড় দালানকোঠায় থাকেন। কিন্তু ধুবড়িতে গিয়ে ছনের ঘর দেখে তিনি তাজ্জব হয়েছিলেন!
মওলানা সব সময় ছনের কুঁড়েঘরেই জীবন পার করে দিয়েছেন, সে ঘর টাঙ্গাইলের সন্তোষে হোক বা আসামের ধুবড়ি গ্রামে। এহেন নেতার সুটকেস কেমন হবে সহসাই আন্দাজ করা যায়।
খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, ভাসানী যখন ইউরোপে গ্রন্থে লিখেছেন, ‘লাগেজ বলতে মওলানা ভাসানীর আজীবনের সাথি একটি মাত্র স্যুটকেস। দৈর্ঘ্য ১৬ ইঞ্চি। সম্পদ বলতে তার মধ্যে থাকে একটি গামছা, একটি লুঙ্গি, একটি খদ্দরের পাঞ্জাবি, মাথার একটা টুপি, কিছু তামাকপাতা ও চুনের একটি ডিব্বা। এসব নিয়েই পূর্ব বাংলার শহরে-গ্রামে সফর করেন এবং এসব নিয়েই তিনি গেছেন ইউরোপ সফরে। চিরসাথি স্যুটকেসটিতে তার তালা নেই। সে বস্তু বিদায় নিয়েছে বহুদিন আগেই। ফলে চির উন্মুক্ত স্যুটকেসটি দড়ি বা শাড়ির পাড় দিয়ে বেঁধে নিয়ে এখানে-সেখানে যেতে হয়।
ঢাকা থেকে যে দড়ি দিয়ে তার একমাত্র লাগেজ বেঁধে আনা হয়েছিল লন্ডনে, একদিন সেটা হারিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল, সেটা ডাস্টবিনে শোভা পাচ্ছে। বাসার ঝাড়ুদার রাবিশ মনে করে সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল।
একদিন তার ইউরোপ সফর সঙ্গিরা বলল, ‘হুজুর, এটা ফেলে দিয়ে একটা নতুন স্যুটকেস কিনে নেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘জীবনের বহুদিনের সঙ্গী আমার এই স্যুটকেসটি। বিদেশবিভুঁইয়ে ওকে না ফেলে দিয়ে দেশে গিয়েই না হয় বদলানো যাবে।’
লন্ডন থেকে স্টকহোমে যাওয়ার পথেও ছেঁড়া লুঙ্গির একাংশ দিয়ে বেঁধে স্যুটকেসটি নিয়ে যাওয়া হলো। স্টকহোম থেকে পুনরায় লন্ডনে ফেরার পথেও সেই ছেঁড়া লুঙ্গির বাঁধন। কিন্তু লন্ডন এয়ারপোর্টে এসে রহস্যজনকভাবে স্যুটকেসটি হারিয়ে গেল। স্যুটকেসটি হারানোর ফলে সফর সঙ্গিরা খুব খুশি হয়। সিদ্ধান্ত হলো একটি নতুন কেনা হবে।
যেদিন স্যুটকেস কেনার জন্য বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই মওলানার সঙ্গে কয়েকবার জেলখাটা সেই স্যুটকেসটি নিয়ে হাজির ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লোক। তারা ক্ষমাটমা চেয়ে নিয়ে জানাল, স্যুটকেসটি ভুলক্রমে ব্রাসেলসে চলে গিয়েছিল।
মওলানার তখনো বেলজিয়াম দেখার সুযোগ হয়নি, অথচ তার জেলখাটা স্যুটকেসটি সে দেশটাও এক চক্কর ঘুরে এসেছে। পুরোনো সাথি পেয়ে তার আনন্দ আর ধরে না। তিনি আরো খুশি হলেন দেখে যে, বিমান কোম্পানি তার ভাঙা স্যুটকেসটি মেরামত করে তাতে একটা তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
আাধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে বদলে গেছে রাজনৈতিক নেতাদের বৈশিষ্ট্যও। যেখানে রাজনীতির অপর নাম বৈভব, সেখানে ভাঙা সুটকেস নিয়ে চলার মতো পরিস্থিতি হয়তো এখন আর নেই। তবে ব্যক্তিগত সংযম, মিতব্যয়িতা, সাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের কাতারে নিজেকে শামিল করার মাঝে নেতৃত্বের গৌরব আছে বৈকি।
