
বন্দনা শিবা। ফাইল ছবি
বন্দনা শিবা, জন্ম ৫ নভেম্বর ১৯৫২ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশের দেরাদুনে। ৭০ বছর বয়সী একজন ভারতীয় পণ্ডিত, পরিবেশ কর্মী, খাদ্য সার্বভৌমত্বের আইনজীবী, পরিবেশবাদী এবং বিশ্বায়নবিরোধী লেখক।
বন্দনা ২০টিরও বেশি বই লিখেছেন। জিএমও বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত তার সক্রিয়তার জন্য তাকে ‘শস্যের গান্ধী’ বলা হয়। শিবা আন্তর্জাতিক ফোরাম অন গ্লোবালাইজেশনের একজন নেতা এবং বোর্ড সদস্য (জেরি ম্যান্ডার, রাল্ফ নাদের এবং হেলেনা নরবার্গ-হজ সহ)।
বন্দনার বীজ সংরক্ষণ আন্দোলন এগিয়ে নিতে নবদন্য (Navadanya) নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
২০১০ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বন্দনা শিবাকে বিশ্বের সাতটি শক্তিশালী মহিলার একজন হিসাবে চিহ্নিত করে। তিনি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাবগুলির বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে আজীবন আগ্রহ দেখিয়েছেন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্বের পক্ষে কথা বলেছেন।
বন্দনা শিবা’র এই রচনাটি ‘yes!’ নামক ওয়েবজিন থেকে ভাষান্তর করেছেন- জয়োস্মিতা সুলতানা
আমার প্রকৃতির জন্য যাত্রা শুরু হয় হিমালয়ের বনগুলোতে। আমার বাবা ছিলেন একজন বন কর্মকর্তা। ভারত-পাকিস্তানের মর্মান্তিক দেশভাগের সময় পালিয়ে আসার পর আমার মা কৃষিকাজ শুরু করেন। প্রকৃতি সম্বন্ধে আমি যা জেনেছি তার বেশিরভাগই আমাকে শিখিয়েছে হিমালয়ের বন ও বাস্তুসংস্থান। আমাদের মা আমাদের জন্য যেসব গান বাঁধতেন, যেসব কবিতা লিখতেন, তার সবই ছিল গাছেদের নিয়ে, বনেদের নিয়ে এবং ভারতের বনসভ্যতা নিয়ে। আমার বাস্তুসংস্থান আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা শুরু হয়েছিল চিপকোর (Chipko) সাথে।
সেসময় হিমালয়ে যে বৃহৎ আকারের বননিধন শুরু হয়েছিল, চিপকো ছিল তার একটি অহিংস প্রতিক্রিয়া। সত্তরের দশকে, আমার অঞ্চল গাড়ওয়াল হিমালয়ের কৃষক নারীরা বন রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন।
গাছ কাটার কারণে ভূমিধস, বন্যা, এবং জল, পশুখাদ্য ও জ্বালানির অভাব দেখা দিয়েছিল। যেহেতু এসকল নারীরাই এ ধরনের মৌলিক চাহিদা সরবরাহ করতেন, এ অভাব দেখা দেওয়ায় জল ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে তাদের ভারী বোঝা নিয়ে আরো দীর্ঘপথ হাঁটতে হত। নারীরা জানতেন, বনের প্রকৃত মূল্য মৃত গাছের কাঠ নয়, বরং তা হল ঝর্ণা ও স্রোত, তাদের গবাদি পশুর জন্য খাদ্য এবং চুলার জন্য জ্বালানি।
নারীরা ঘোষণা করেছিলেন যে তারা বনের সকল গাছকে এমনভাবে জড়িয়ে রাখবে যেন গাছেদের মেরে ফেলতে হলে আগে তাদের মারতে হয়। সেসময়ের একটি লোকসঙ্গীত ছিল এমন, "এসকল সুন্দরতম ওকগাছ ও রডোডেনড্রেন, আমাদের দেয় সুশীতল জল, ওদের হত্যা কোরোনা, আমাদের তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে”।
১৯৭৩ সালে, পিএইচডির জন্য কানাডা যাবার আগে আমি আমার প্রিয় বন দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেসব বন আর ছিলনা। আমার প্রিয় জলপ্রবাহে সাঁতার কাটতে গিয়ে দেখি সেটিও পরিণত হয়েছে কেবল একটি ক্ষীণ স্রোতে। সেসময় আমি চিপকো আন্দোলনের একজন স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার ছুটিতে আমি এ নিয়ে পদযাত্রা করতাম, চিপকোর বার্তাগুলোর প্রসার করতাম, বননিধনের তথ্য ও যারা এ নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছিল তাদের কাজের নথি সংগ্রহ করতাম।
চিপকোর অন্যতম নাটকীয় একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৭ সনে, হিমালয়ের একটি গ্রাম আদওয়ানিতে। গাছ কাটার একটি চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় গ্রামের একজন নারী বাছনি দেবী তার নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। বনের কর্মকর্তারা যখন উপস্থিত হলেন, প্রখর দিনের আলোতে গ্রামের নারীরা তখন প্রজ্জ্বলিত লণ্ঠন ধরে প্রতিবাদ জানালেন। "বনরক্ষক" তাদের এ কাজের ব্যাখা জানতে চাইলে নারীরা জবাব দিলেন, "আমরা আপনাদেরকে বনবিদ্যা শেখাতে এসেছি।"
"বনরক্ষক" বললেন, "তোমরা মূর্খ নারী। যারা বনের মূল্য জানে তাদের গাছ কাটা থেকে ঠেকাবে কীভাবে? বন কী বহন করে জানো? বন লাভজনক, বন রেসিন ও কাঠ উৎপাদন করে।" নারীরা তখন সমস্বরে জবাব দেন, "বন কী ধারণ করে? মাটি, জল ও বিশুদ্ধ বাতাস। মাটি, জল ও বিশুদ্ধ বাতাস পুরো পৃথিবী ও পৃথিবীতে যা কিছু অস্তিত্বমান, সমস্তকে বাঁচিয়ে রাখে।"
চিপকো থেকে আমি জীববৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্য ভিত্তিক অর্থনীতি সম্পর্কে জানি, এবং এদুটোর সুরক্ষা আমার জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। আমার বই 'মনোকালচারস অব দ্য মাইন্ড' এ যেমন বর্ণনা করেছি, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির দুর্গতির মূলে রয়েছে জীববৈচিত্র্য ও এর বিভিন্ন কার্যকলাপ বুঝতে না পারা। হিমালয়ের বনে জীববৈচিত্র্য সম্বন্ধে পাওয়া শিক্ষা আমি আমাদের খামারগুলোর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজে লাগিয়েছি।
আমি কৃষকদের মাঠ থেকে বীজ সংরক্ষণ করা শুরু করি এবং তারপর বুঝতে পারি যে আমাদের প্রকাশ ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি ফার্ম দরকার। এইভাবে ১৯৯৪ সনে উত্তরাখণ্ড প্রদেশের নিম্নস্থানে হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত দুন উপত্যকায় নবদন্য ফার্ম শুরু হয়। আজ আমরা ৬৩০ প্রজাতির ধান, ১৫০ প্রজাতির গম ও অন্যান্য শত শত প্রজাতি সংরক্ষণ ও উৎপাদন করি।
আমরা জীববৈচিত্র্যভিত্তিক কৃষিব্যবস্থার চর্চা ও তার প্রচার করি যা প্রতি একরে অধিকতর খাদ্য ও পুষ্টি উৎপাদন করে। জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ তাই খাদ্য ও পুষ্টি সংকট সমস্যারও সমাধান। 'Navdanya' - যে আন্দোলনটি আমরা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জৈব চাষের জন্য ১৯৮৭ সালে শুরু করেছিলাম, তা ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষকদের সাথে কাজ করে এ পর্যন্ত আমরা ভারতজুড়ে ১০০টিরও বেশি বীজ ব্যাংক স্থাপন করেছি।
৩০০০ এর বেশি রকমের ধান সংরক্ষণ করেছি। জীবাশ্ম জ্বালানি ও রাসায়নিক ভিত্তিক মনোকালচার থেকে সরে, সূর্য ও মাটি পুষ্টি সাধন করে এমন জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ ব্যবস্থায় কৃষকদের ফেরাতে আমরা সহায়তা করে থাকি। জীববৈচিত্র্যই আমাকে বুঝিয়েছে স্বাধীনতা ও প্রাচুর্যর সত্যিকার মানে, শিখিয়েছে পারস্পারিক প্রদান ও সহযোগিতা।
যখন প্রকৃতি আমাদের শিক্ষক, তখন আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সৃজন করতে পারি, প্রকৃতির কর্তৃত্ব ও অধিকারকে বুঝতে পারি। ইকুয়েডর তার সংবিধানে ‘রাইটস অব নেচার’ কে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইকুয়েডরের সংবিধান ও বলিভিয়া কতৃক প্রবর্তিত 'ইউনিভার্সেল ডিক্লিয়ারেশন অব দ্য রাইটস অব মাদার আর্থ' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে 'ধরিত্রী দিবস' উদযাপনের অংশ হিসেবে 'হারমনি উইথ নেচার' নামক সম্মেলনের আয়োজন করে।
সেখানে বেশিরভাগ আলোচনার কেন্দ্রে ছিল কীভাবে প্রকৃতির ওপর মানুষের, নারীর ওপর পুরুষের এবং দরিদ্রের ওপর ধনীর কর্তৃত্বমূলক শৃঙ্খলাকে ভেঙে পারস্পরিক অংশদারিত্বমূলক ধারা তৈরী করা যায়। সম্মেলনটিতে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের একটি প্রতিবেদন 'হারমনি উইথ নেচার' প্রকাশ করা হয়। সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে পুনরায় সংযোগের গুরুত্বকে বিশদভাবে বর্ণনা করে বলে যে, ‘নিখিলের সঙ্গে মানুষের কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই, নিখিলের অনিষ্ট মানে আদতে নিজেরই অনিষ্ট। এটা উপলব্ধি করতে পারে না বলেই মানুষ প্রকৃতির ওপর ধ্বংসাত্মক আচরণ করে থাকে।’
প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতির সাথে অসঙ্গতি ও এর বিরুদ্ধে সহিংসতার মূল কারণ হল বিচ্ছিন্নতাবাদ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশিষ্ট পরিবেশবিদ কর্ম্যাক কুলিনান বলেন, বর্ণবাদ মানে বিচ্ছিন্নতা। বর্ণের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে হিংসাত্মক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে সারা পৃথিবী যোগ দিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার সে বর্ণবৈষম্যকে আমরা পেছনে ফেলতে পেরেছি। আজ, বৃহত্তর ও গভীরতর বৈষম্যটিকে আমাদের কাটিয়ে ওঠা উচিত। সেটাকে ইকো-বৈষম্য বলা যেতে পারে, যা আমাদের মনে নিখিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আপনার যোগকে অস্বীকার করার মতন বিভ্রম সৃষ্টি করে।
বিচ্ছিন্নতার ধারণার দ্বারাই শুরু হয় জগৎপ্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এর সমসাময়িক বীজ বপন করা হয়েছিল যখন চেতনাময় বিশ্বপ্রকৃতি মৃত বস্তুতে পরিণত হয়েছিল কেবলমাত্র শিল্প বিপ্লবকে সহজতর করার জন্য। বৈচিত্র্যের বদলে এল এক-ফসলী চাষ। প্রাণচঞ্চল এ পৃথিবীর স্থানে জায়গা পেল "কাঁচামাল" ও "জড় বস্তু"। Terra Madre (জগৎমাতা) এর বদলে হল Terra Nullius (জনবসতিহীন খালি জমি, যা আদিবাসীদের বসবাস অগ্রাহ্য করে বেদখল করা হয়)।
এ প্রসঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন যে, বিজ্ঞান ও এর উদ্ভাবনগুলো প্রকৃতির ওপর কেবল মৃদু প্রভাব ফেলে না। তাদের প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব রাখার ও প্রকৃতিকে বশীভূত করার ক্ষমতা আছে, এমনকি তা প্রকৃতির ভিত্তি অবধি নাড়িয়ে দিতে পারে। সতের শতকের বিখ্যাত রসায়নবিদ ও নিউ ইংল্যান্ড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে খ্রিষ্টীয় ধর্মপ্রচার সংক্রান্ত কর্পোরেশনের গভর্নর, রবার্ট বয়েল, স্থানীয় লোকেদের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাদের পূর্ব ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করে চেয়েছিলেন।
প্রকৃতিকে এক ধরণের ঈশ্বর ভাবার ধারণার প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন যে, "প্রকৃতির পূজা করা মানে হল ঈশ্বরের নিম্নজাত সৃষ্টির ওপর মনুষ্য রাজত্ব সৃষ্টির পথে বাধা তৈরী করা"। মৃত প্রকৃতির ধারণাটি পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করে। সর্বোপরি, পৃথিবী যদি একটি মৃত বস্তুই হয়, তাহলে কোনোকিছুই আদতে হত্যা করা হচ্ছেনা।
ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ক্যারোলিন মার্চেন্ট উল্লেখ করেছেন, সপ্রাণ ও আমাদের লালনপালনকারী প্রকৃতিমাতাকে জড়, মৃত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য বস্তুতে পরিণত করা মূলত পুঁজিবাদের দিকে ক্রিয়াকলাপকে পরিচালনা করা। বেকন ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অন্যান্য পথপ্রদর্শকদের দ্বারা তৈরী আধিপত্য বিস্তারকারী চিত্রগুলো লালনপালনকারী পৃথিবীর চিত্রগুলোকে প্রতিস্থাপিত করেছিল।
প্রকৃতিকে শোষণ করার সাংস্কৃতিক বাঁধাও তাদের দ্বারা বিলুপ্ত হয়েছে। মার্চেন্ট লিখেছেন, " আমরা মা'কে সহজে হত্যা করিনা, তার অন্ত্র অবধি খনন করে চলি স্বর্ণের জন্য, ও তাকে ছিন্ন-ভিন্ন, বিকৃত করি।"
আজ, বিশ্বায়নের ফলে তীব্রতর হওয়া বহুবিধ সংকটের সময়ে, প্রকৃতিকে মৃত বস্তু হিসেবে অনুশীলন করা থেকে আমাদের বিরত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের বাস্তুসংস্থানগত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত, এবং তার জন্য প্রকৃতি নিজেই আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। এ উদ্দেশ্যেই আমি নবদন্য ফার্মে বীজ বিদ্যাপীঠ (Earth University) শুরু করেছি। এ বিদ্যাপীঠটি 'আর্থ ডেমোক্রেসি’ সম্বন্ধে শেখায়, যা পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতির বিকশিত হতে পারার স্বাধীনতার কথা বলে, এবং পৃথিবীর সদস্য হিসাবে মানুষকে অন্য সকল প্রজাতির অধিকারকে স্বীকৃতি, রক্ষা ও শ্রদ্ধা করতে শেখায়।
আর্থ ডেমোক্রেসি মানবকেন্দ্রিকতা থেকে পরিবেশকেন্দ্রিকতায় পরিবর্তিত হতে বলে। এবং যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল, এই ডেমোক্রেসি মানুষকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থেকে মুক্তি দিয়ে খাদ্য ও জলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রগামী।
আর্থ ইউনিভার্সিটি যেহেতু জীববৈচিত্র্যভিত্তিক নবদন্য ফার্মে অবস্থিত, এখানে অংশগ্রহণকারীরা সপ্রাণ বীজ, সপ্রাণ মাটি ও জীবনজালের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে শেখে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছে কৃষক, স্কুলপড়ুয়া শিশু, এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রকৃতিসচেতন মানুষ। আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি কোর্স হল ‘দ্য এ- জেড অর্গানিক ফার্মিং অ্যাণ্ড এগ্রোইকোলজি’ এবং ‘গান্ধী অ্যাণ্ড গ্লোবালাইজেশন’।
আর্থ ইউনিভার্সিটি ভারতের জাতীয় কবি ও নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে একটি বনভিত্তিক শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক নবজাগরণ সৃষ্টি করা। ১৯২১ সনে শিক্ষালয়টি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে এবং ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর একটিতে পরিণত হয়।
আজ, ঠিক রবীন্দ্রনাথের সময়ের মতই, বাধাহীন শিক্ষালাভের জন্য আমাদের বন ও প্রকৃতির দিকে মুখ ফেরাতে হবে। ‘দ্য রিলিজিয়ন অব দ্য ফরেস্ট’ রচনায় রবীন্দ্রনাথ চিরায়ত ভারতীয় সাহিত্যে প্রাচীন ভারতের অরণ্যবাসীদের প্রভাব সম্বন্ধে লিখেছেন। বন হল জলের উৎস ও জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার যা আমাদের গণতন্ত্র শেখাতে পারে, আমরা শিখি জীবনের জাল হতে ভরণপোষণ নেবার সময় অপরের জন্যেও জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতাকে রবীন্দ্রনাথ মানব বিবর্তনের সর্বোচ্চ পর্যায় হিসেবে দেখেছেন। "তপোবন" রচনায় তিনি লেখেন, "ভারতীয় সভ্যতার মূল প্রস্রবন শহরে নয়, বনে। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুলো এসেছিল যখন মানুষ ভিড় থেকে দূরে নদী, গাছ ও হ্রদের কাছাকাছি বাস করত। যে ওষধি-বনস্পতির মধ্যে প্রকৃতির প্রাণের ক্রিয়া দিনে রাত্রে ও ঋতুতে ঋতুতে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে এবং প্রাণের লীলা নানা অপরূপ ভঙ্গীতে, ধ্বনিতে ও রূপবৈচিত্রে নিরন্তর নূতন নূতন ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে, তারই মাঝখান থেকে বনের সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে দেখতে পাই অরণ্যের নির্জনতা মানুষের বুদ্ধিকে অভিভূত করেনি বরঞ্চ তাকে এমন একটি শক্তি দান করেছিল যে সেই অরণ্যবাসনিঃসৃত সভ্যতার ধারা সমস্ত ভারতবর্ষকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে এবং আজ পর্যন্ত তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়নি। সে সভ্যতার ধারা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনে সাহায্য করেছে। বৈচিত্র্য ও গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের মাঝখানে জীবনের একীকরণ নীতিকে ভারতীয় সভ্যতার নীতিতে পরিণত করেছে।"
রবীন্দ্রনাথের লেখায়, বন শুধু জ্ঞান ও স্বাধীনতার উৎস নয়। বন সৌন্দর্য ও আনন্দের উৎস, শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের, সম্প্রীতি ও পরিপূর্ণতার উৎস। বন এ মহাবিশ্বেরই প্রতীকীরূপ।
‘দ্য রিলিজিয়ন অব দ্য ফরেস্ট’ রচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমাদের মনের কাঠামো সৃষ্টিজগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা পরিচালিত করে দুইভাবে, হয় ক্ষমতা চর্চা ও প্রভুত্ব স্থাপন করে, বা ঐক্য ও সহানুভূতির মাধ্যমে মহাবিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। বন আমাদের এই ঐক্য ও সহানুভূতি শেখায়। বন পর্যাপ্ততাও শেখায়।
কীভাবে শোষণ ও পুঁজি করা ছাড়াই প্রকৃতির উপহার উপভোগ করা যায়, আমরা ন্যায়ের সেই নীতিটিকে শিখি। অরণ্যে লেখা প্রাচীন গ্রন্থগুলো থেকে রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেছেন, "এই চলমান পৃথিবীতে যা কিছু চলে তার সবই ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত হিসেবে জেনো; দখল করার লোভের ভেতর আনন্দকে না খুঁজে, ত্যাগের ভেতর আনন্দকে সন্ধান করো"।
একটি বনের কোনো প্রজাতিই অন্য প্রজাতির প্রাপ্য অংশে হস্তক্ষেপ করে না। প্রতিটি প্রজাতি একে অন্যের সহযোগিতায় নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখে। ভোগবাদ ও পুঁজির অবসান হল বেঁচে থাকার আনন্দের শুরু। লোভ, যুদ্ধ, সহিংসতার সঙ্গে সহানুভূতি, সহযোগিতা ও সম্প্রীতির মধ্যকার যে দ্বন্দ্বের কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তা আজও অব্যাহত আছে। আর অরণ্যই আমাদের এসকল দ্বন্দ্ব থেকে বের হওয়ার পথ দেখাতে পারে।
মূলরচনা: Everything I Need to Know I Learned in the Forest By Vandana Shiva